গত আসরে সিলেট সিক্সার্সের হয়ে আলো কেড়েছেন। জায়গা করে নিয়েছেন জাতীয় দলের দুই ফর্মেটে। সেই ফর্ম চলতি বিপিএলে ধরে রেখেছেন বগুড়ার এ তরুণ। গতকাল রাতে জয়সূচক রান নেওয়ার পর থেকেই তাওহিদ হৃদয়কে ঘিরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের উৎসব শুরু। সেটা চলতে থাকল ড্রেসিংরুমে, পুরস্কার বিতরণীর মঞ্চেও। অপরাজিত শতকে কুমিল্লাকে ম্যাচ জিতিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও উঠেছে হৃদয়ের হাতে। এরপর টিভি সম্প্রচারকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিলেন। ছোট্ট সাক্ষাৎকারের ওই সময়েও হৃদয়কে ঘিরে একটা জটলা বেধে গেল। সেই ভিড় ঠেলতে ঠেলতেই হৃদয়ের সংবাদ সম্মেলনকক্ষে আসা। কেউ চাইছেন অটোগ্রাফ, কেউ সেলফি। কেউ এসে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন।

অবশ্য মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আজ হৃদয় যা করেছেন, তাতে এই উন্মাদনা বাড়াবাড়ি মনে হবে না। দুর্দান্ত ঢাকার ১৭৪ রানের পেছনে ছুটতে গিয়ে হৃদয়ের কুমিল্লা ২৩ রান তুলতেই ৩ উইকেট হারিয়ে বসে। সেখান থেকে ৫৭ বলে ১০৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন হৃদয়। ৮টি চার ও ৭টি ছক্কায় ১৮৯ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসটি সাজিয়েছেন তিনি। হৃদয়ের ক্যারিয়ারের প্রথম টি-টোয়েন্টি শতক এটি, এবারের বিপিএলেও প্রথম। রান–খরার ঝিমিয়ে পড়া বিপিএলকে জাগিয়ে তুলতে এমন কিছুই হয়তো দরকার ছিল।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, হৃদয় নাকি শতকের চিন্তা করে ব্যাটিংই করেননি! ৯০–এর ঘরে এসেও তাঁর ভাবনা ছিল এমন, ‘আমি শুধু চেষ্টা করেছি তাড়াতাড়ি ম্যাচটা শেষ করার।’ অন্য প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘আমি এক শর জন্য খেলিনি। ৯০ রানের পরেও না। চেষ্টা করেছি ফিনিশ করার।’ ইনিংসের শুরুতে দল যখন ঘোর বিপদে, তখনো একই মানসিকতায় ব্যাটিং করেছেন তিনি, ‘প্রত্যেক ব্যাটসম্যানেরই স্বপ্ন থাকে এক শ করার। গত বছর সুযোগ ছিল, আসেনি। এবার হয়েছে। উইকেট গেলেও আমার পরিকল্পনা ছিল মেরে খেলার।’

হৃদয়কে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মিরপুরের রাতের কন্ডিশন। প্রথম ইনিংসে হৃদয়েরই বয়সভিত্তিক দলের দুই সতীর্থ মোহাম্মদ নাঈম ও সাইফ হাসান অর্ধশত করেছেন। দ্বিতীয় ইনিংসে কন্ডিশন আরও ব্যাটিং সহায়ক মনে হয়েছে। হৃদয়ই বললেন, ‘অন্য দিনের তুলনায় উইকেট ভালো ছিল।’ বিস্ফোরক ইনিংসটি ৭টি ছক্কায় সাজিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান। এতগুলো ছক্কার মধ্যে কোনটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে? প্রশ্নটা শুনতেই হেসে দিলেন হৃদয়, ‘কোনটা বলতে পারব না। কিন্তু ৬ মারতে ভালোই লাগে (হাসি)।’

ছক্কা মারতে তো শক্তিও লাগে। হৃদয়ের এত শক্তি এল কীভাবে? তরুণ এই ব্যাটসম্যান হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, ‘যেটা বললেন, ছয় মারতে পাওয়ার (দরকার হয়), বড় প্লেয়াররা ওয়েস্ট ইন্ডিজের যারা আছে, তারাই বড় ছয় মারে। আমাদের দেশের ব্যাটাররাও বড় ছয় মারে। আপনি যদি খেয়াল করে দেখেন, প্রত্যেকটা ব্যাটারই বড় বড় ছয় মারে।’

তবে মেরে খেলার মানসিকতায় যে কিছুটা ঘাটতি আছে, তা মেনে নিলেন এই তরুণ, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা এ রকম পরিস্থিতিতে কম অভ্যস্ত। আমরা যখন আস্তে আস্তে খেলতে থাকব, আরও ম্যাচে যখন এ রকম ছয় মারব, প্রত্যেকটা ব্যাটার যখন মারবে, তখন আত্মবিশ্বাসটা আসবে যে আমি মারলে ছয় হবে।’ পরে যোগ করলেন, ‘আমি মনে করি, ছয় মারা কঠিন কিছু না। যদি আত্মবিশ্বাসটা থাকে, আমার মনে হয় ছক্কা যেকোনো সময় যেকোনো মাঠে হবে।’

হৃদয় তাঁর স্মরণীয় ইনিংসটি উৎসর্গ করেছেন মাকে। যিনি জমি বিক্রি করে ঢাকার একটি একাডেমিতে হৃদয়ের ক্রিকেট শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু একাডেমিতে ক্রিকেট শিক্ষার নামে হৃদয়কে প্রতারণার শিকার হতে হয়। তবু থেমে থাকেনি তাঁর ক্রিকেটার হওয়ার চেষ্টা। আজ টি-টোয়েন্টির প্রথম শতকের পর সেই মাকেই স্মরণ করলেন এই তরুণ।

তবে হৃদয়ের কাছে আজকের ইনিংসটি তাঁর ছোট্ট ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস নয়। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে টানা তিন শতক এখনো হৃদয়ের কাছে ‘বিশেষ’। সেটি ছাড়িয়ে যেতে হলে নিশ্চয়ই জাতীয় দলের হয়েও সে রকম কিছু করতে হবে। সংবাদ সম্মেলন শেষে বের হতে হতে সে স্বপ্নও দেখালেন।
কিছুক্ষণ পর হৃদয় আবারও হারিয়ে গেলেন ছোট্ট একটা জটলায়। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ সেলফি। হৃদয় সবার আবদার মেটালেন। আজ তাঁর আবদার মেটানোরই দিন।