বিশ্বব্যাপী এখন কেবল একটাই সংবাদ ‘মৃত্যু’। একটি মৃত্যু সংবাদের রেশ কাটতে না কাটতেই হাজির আরো দশটি নিষ্ঠুর সংবাদ। প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। করোনাভাইরাস নামের এই যমদূতের করুণ থাবায় গোটা বিশ্ব আজ ক্ষত-বিক্ষত। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ আজ অসহায়, নির্বাক। জনবিচ্ছিন্ন মানুষ বন্দী ঘরে একের পর এক মৃত্যুর খবরে ছটফট করলেও কিছুই করতে পারছে না। একান্ত আপনজন, স্বজন কিংবা প্রিয় মানুষ চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে, অথচ অতি কাছে থেকেও তাকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে পারছে না। এ কেমন মৃত্যু! যে মৃত্যুতে তার অতি আপনজনেরাও একটিবারের জন্য তাকে ছুঁয়ে কান্না করার অধিকারটুকুও পাচ্ছে না।

মৃত্যুপুরী যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে চার দেয়ালের বন্দী ঘরে বসে যখন এই বিভীষিকাময় কাল অতিক্রম করছি, ঠিক তখনই আমাদের একের পর এক অতি প্রিয় মুখ গুলোর চিরবিদায়ের খবর পেয়ে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা হৃদয়টা ভেঙে একেবারে খান খান হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আপনারা সকলেই জেনে গেছেন নিউইয়র্ক প্রবাসীদের আমব্রেলা খ্যাত বাংলাদেশ সোসাইটি ইউএসএ ইনক’র বর্তমান সভাপতি, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান, কমিউনিটির প্রিয়মুখ কামাল আহমেদের কথা। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সঙ্গে ৫ দিন যুদ্ধ করে অবশেষে হেরে গিয়ে চিরবিদায় নিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই অগ্রদূত।

এমন এক সময়ে কামাল ভাই চলে গেলেন, যখন করোনাভাইরাস মহামারিতে চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে পড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অনেকে বলেছেন, যে মানুষটি তার প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির উদ্যোগে প্রবাসীদের দাফনে-কাফনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন, আজ সেই মানুষটিকেই চলে যেতে হয়েছে বড় অসময়ে। তাকে হারিয়ে তার প্রিয় মানুষেরা অসহায় এবং দুঃখ ভারাক্রান্ত। কমিউনিটি হারাল তাদের এক বন্ধু ও অভিভাবককে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, নিউইয়র্কে অবস্থান করেও অতি আপনজন কামাল ভাইকে কাছে থেকে শেষবিদায় জানাতে পারছি না। আমার জন্য এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে। আমার অনিচ্ছাকৃত এই অপারগতাকে ক্ষমা করে দেবেন, প্রিয় কামাল ভাই। কারণ আপনি নিশ্চয় জানেন, করোনা কতটা করুণ ও নির্মম! সে মৃত ব্যক্তির প্রিয়জনকে পাশে থাকতে দেয় না, শেষবারের মতো মুখখানি দেখতে দেয় না এমনকি শবযাত্রা বা জানাজায়ও অংশগ্রহণ করতে দেয় না! তাই দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে বসে থেকে মহান আল্লাহর দরবারে এই প্রার্থনা করছি, আল্লাহ আপনাকে বেহেশত নসিব করুন।

কামাল আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই স্কুলজীবন থেকে। জন্ম সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা গ্রামে হলেও তিনি ষাটের দশকে স্কুলজীবন কাটিয়েছেন আমার জন্মমাটি কুলাউড়ায়।পরে তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁর ছোট ভাই আউয়াল আমাদের সহপাঠি হওয়ার সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি তরুণ বয়সে জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর অভিভাবক হিসেবে আমাকে যে কজন বুকে আগলে রাখতেন, তাদের মধ্যে কামাল ভাই ছিলেন অন্যতম। মনে পড়ে, ক্ষুধা পেলেই দৌড়ে চলে যেতাম তার সানিসাইডের বাসায়। কখনো এমন হয়েছে, জিজ্ঞাসা না করেই রান্নাঘরে ঢুকে নিজ হাতেই খেয়ে নিতাম। পরে আমেরিকায় পাড়ি জমালেন বন্ধু বাবলা। তিনসহ অনেকেই আমার সঙ্গী হতেন প্রায়ই। আশির দশকের পুরোটা সময় কেটেছে তিনি ও তার পরিবারের সঙ্গী-সাথি হয়ে। ভাবিও আমাদের আপন করে নিয়েছিলেন পরিবারের একজন হিসেবেই।

স্মৃতির পাতা হাতড়ে আরো মনে পড়ে, আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসীদের কল্যাণের লক্ষ্যে গঠন করি জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংগঠন, যা আজ আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অতি পরিচিত এক সংগঠন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন গঠনের সময় যে কজন প্রবাসী বাংলাদেশি এগিয়ে এসে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের মধ্যে কামাল আহমেদ অন্যতম। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেলী মুবদি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি আর ওই কমিটির কোষাধ্যক্ষের গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয় কামাল ভাইকে। পরে তিনি বিয়ানীবাজার সমিতির সভাপতি ও জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। সর্বশেষ কামাল আহমেদ বাংলাদেশ সোসাইটি যুক্তরাষ্ট্রের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যু অবধি তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। তার কর্মময় জীবন ছিল নিউইয়র্কের সকল প্রবাসীকে ঘিরে। এ জন্য তিনি ছিলেন কমিউনিটির প্রিয়মুখ।

প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে কামাল ভাই আসলে নিজের ও পরিবারের প্রতি তেমন নজর দেওয়ার সময় পেতেন না। তাই প্রবাসে দীর্ঘকাল কাটালেও নিজের জন্য কিছুই করতে পারেননি। কবি সালেম সুলেরীর স্ট্যাটাস থেকে জানতে পারলাম জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে পৈতৃকবাস বিয়ানীবাজারের লাউতা গ্রামে বানিয়েছিলেন চারতলা একটি নতুন বাড়ি। কিন্তু সময়ের অভাবে দেশে যেতে না পারায় নিজ চোখে তা না দেখেই বিদায় নিলেন তিনি। সম্প্রতি নিউইয়র্কের উডসাইডেও তিনি একটি বাড়ি ক্রয় করেন। বাড়িটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, উদ্দেশ্য ছেলে রফিকে বিয়ে দিয়ে বাকি জীবনটা এই নিবাসেই সুখের প্রদীপ জ্বালিয়ে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু বিধি বাম! সেই মুহূর্তেই করোনার ভয়াল ছোবল তার জীবনপ্রদীপকেই নিভিয়ে দিল। কিছু মানুষ আছেন, যাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়ার আগেই তারা পরপারে পাড়ি জমান আর এই অপূর্ণতার দগদগে ক্ষত দীর্ঘ সময় বয়ে বেড়ান তার স্বজন ও কাছের মানুষজন। কামাল ভাইও তাদেরই একজন, যিনি জীবদ্দশায় বহু মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটালেও নিজে অতৃপ্ত থেকেই পৃথিবীকে বিদায় জানালেন।

করোনার এই মরণছোবলে কামাল ভাইসহ যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ জন প্রবাসী (ডা. মোহাম্মদ ইফতেকার উদ্দীন কাঞ্চন, আজাদ বাকির,সৈয়দ রহমান,মীর্জা হুদা,আমিনা ইন্দ্রালিব তৃষা, সাইফুল আজাদ, নিশাত চৌধুরী, মাওলানা ইসাক মিয়া, বাবুল মিয়া, মো আজাদুর রহমান, বাবুল মিয়া (ব্রুকলিন)হাফেজ রুবেল, তোফায়েল আহমেদ, ইসরাত জাহান,তাহমিনা ইসলাম খান, তানভির হাসান খান প্রিন্স, সাইফুর হায়দার খান আজাদ, শিফন আহমেদ, তাহের আহমেদ, মনিরুল হুদা, আমিন উল্লাহ, জিল্লুর রহমান, খালেকুজ্জামান মানিক, মিলন রহমান, বিজিত সাহা, জালাল উদ্দিন মোস্তাক,  খালেদ হাশমত, আয়ূব আলী, রফিক, মহসিন, শফিকুল ইসলাম, ডা শাকিল সালেহীন, বাবুল আহমেদ, সূর্য বনিক, গিয়াস আহমেদ, বাচ্চু মিয়া, মো ইব্রাহিম খান, শামসুল হুদা চৌধুরী, সুফি মিয়া, মুনিম চৌধুরী, নুসরাত মজুমদার, সুরুজ খান, মোতাব্বির চৌধুরী ইসমতসহ নাম না জানা আরো অনেকে)- বাংলাদেশি মারা গেলেন, আর সারা বিশ্বে এই সংখ্যা ৮০ জনেরও বেশি। আমি সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। পাশাপাশি সবার পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানাচ্ছি সমবেদনা। প্রার্থনা করছি, আর কোনো প্রবাসী বাংলাদেশি যেন এই নির্মম পরিণতির শিকার না হন।

যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণকারী মানুষের সংখ্যা। ইতিমধ্যে (৬ এপ্রিল পর্যন্ত) সারা বিশ্বে ১৩ লক্ষাধিক লোক আক্রান্ত ও ৭৪ হাজারের বেশি লোক মারা গেছে। এর মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, চীন, ইরানসহ অনেক দেশের। বাংলাদেশেও দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। করোনা তার সর্বগ্রাসী তান্ডবলীলা কবে থামাবে, তা কেবল আল্লাহই মালুম। তাই আসুন, সবাই মিলে প্রার্থনা করি এই ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে যেন আমরা অচিরেই মুক্তি পাই।

লেখক -সাবেক সংসদ সদস্য।