এবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় নানা সমস্যা আর সংকট সঙ্গী হয়েছে মৌলভীবাজারের ৩ উপজেলার হাওরতীরের বন্যাকবলিতদের। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বির্পযস্ত এ অঞ্চলের লোকজন। ৩য় দফা বন্যায় এখন নতুন উপদ্রব পানিবাহিত রোগ-বালাই। বন্যাকবলিত নি¤œাঞ্চলের লোকজন এখন পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা। এর অন্যতম কারণ, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যানিটেশন সংকট।

বন্যার্তদের খাবার পানি বিশুদ্ধ করার জন্য দেওয়া হচ্ছে ওষুধ। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। আর রান্নাঘর বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিকল্প পদ্ধতিতে রান্নার কাজে নিত্যপ্রয়োজনীয় রান্না ছাড়া পানি ফোটানোর পর্যাপ্ত সুযোগও নেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের। আর টয়লেটগুলো পনিতে ডুবে যাওয়ায় স্যানিটেশন সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এখন বন্যার পানিতে হাওরপাড়ের ঘরবাড়ি একাকার। এ বছর দফায় দফায় বন্যার সৃষ্টি হওয়ায় অনেকটাই সর্বস্বহারা হাওরতীরের কৃষি ও মৎস্যজীবি পরিবারগুলো। বানের পানিতে একে একে তলিয়ে গেছে সব। এবার প্রথমদিকের দু’টি বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয় বোরো ধানের। ধান পচে পানি দূষিত হয়ে মরে মাছ, হাঁস, জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদ। আর চলমান ৩য় দফার বন্যায় ডুবে যায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়। সাথে বিশুদ্ধ খাবার পানির উৎস টিউবওয়েলও। তলিয়ে যায় রান্নাঘর আর টয়লেট। এ নিয়ে হাওরতীরের বন্যাকবলিত লোকজনের দুর্ভোগের শেষ নেই। বানের পানিতে বিশুদ্ধ খাবার পানি আর টয়লেট ডুবে থাকায় তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। তাই যেমন খাচ্ছেন বন্যার দূষিত পানি। তেমনি বাধ্য হয়ে বন্যার পানির উপর-ই (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন) সারছেন টয়লেটের কাজ। স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে বানভাসী মানুষ এখন আক্রান্ত হচ্ছেন পানিবাহিত নানা রোগে।  ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, কাশি, আমাশয়, চর্মরোগ, কৃমি ও পেটের পীড়াসহ নানা রো ছড়িয়ে পড়ছে। একে তো ঘরে খাবার নেই। পেটে রাজ্যের ক্ষুধা। তাই  রোগ তাড়াতে ওষুধ কেনার সাধ্য কোথায় তাদের? এ কারণে রোগের সাথে আপোষ করেই তাদের চলতে হচ্ছে। চৈত্রের অকাল বন্যার পর ৩য় দফার চলমান বন্যায় এখন এমন স্বাস্থ্য অবস্থা হাওরতীরবর্তী বন্যাকবলিত নারী ও পুরুষের।

আয়-রোজগার নেই তাই হাতে টাকাও নেই। এমন অসহায়ত্বে রোগ সারাতে মনোবল আর ধৈর্য্যই একমাত্র পুঁজি তাদের। মাঝে-মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণায় অধৈর্য্য হলে রোগ সারাতে স্থানীয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা উপজেলা সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভীড় জমান রোগীরা। কিন্তু সেখানে গিয়েও মিলছে না ডাক্তার কিংবা ওষুধ। আর অনেক সময় ডাক্তার পাওয়া গেলেও তাদের রূঢ় আচরণে হতে হয় নাজেহাল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজার অংশের বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার মধ্যে ২টি উপজেলায় রয়েছে সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু এই দু’টি হাসপাতালেও রয়েছে ডাক্তার, ওষুধ ও  লোকবলসহ নানা সমস্যা ও সংকট। আর যা আছে তারও সদব্যবহার হচ্ছে না বলে রয়েছে ভুক্তভোগীদের সীমাহীন অভিযোগ। এবার হাওর উত্তাল হয়ে সব যেনো একে একে গিলে খাচ্ছে হাওরতীরের বাসিন্দাদের। এমন বিপর্যয় এর আগে কখনও এমনভাবে দেখেনি তারা। তাই ঘরে যেমন খাদ্য নেই।  তেমনি না থাকার তালিকায় আছে ওষুধ ও অনান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও। তাই হাওরজুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। কর্মহীন মানুষগুলো পুরোপুরিই বেকার। এমন অভাব আর অনটনের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা অসুখ-বিসুখ।

সরজমিনে হাওরতীরের বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া অংশের একাধিক ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে বন্যাকবলিত মানুষের ঘরবাড়িতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পানিতে ডুবে থাকায় বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বানভাসী অনেকেই জানালেন, তারা বানের পানি যেমন খাচ্ছেন। তেমনি তা দিয়ে রান্নাবান্নাসহ অনান্য প্রয়োজনীয় কাজও সারছেন। তাদের টিউবওয়েল পানিতে ডুবে থাকায় এমন বেহাল অবস্থা। আর বন্যাক্রান্ত পুরো গ্রামের মধ্যে যে দু’একটি টিউবওয়েল উঁচু স্থানে  কোনো রকমে ভেসে আছে সেখান থেকে বানের পানি ঠেলে গিয়ে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করাও কষ্টকর।

ভুক্তভোগীরা জানান, গত কয়েক দিন থেকে তাদের পরিবারের সদস্যরা নানা রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন। ওষুধ কেনার সাধ্য নেই তাই ওরস্যালাইন খেয়ে রোগ তাড়াচ্ছেন। এখন প্রতিনিয়তই তারা আক্রান্ত হচ্ছেন ডায়রিয়া, জ¦র, সর্দি, কাশি, আমাশয়, চর্মরোগ, কৃমি ও পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগে। ওই এলাকার স্থানীয় হাট-বাজারের ছোট-বড় ফার্মেসিগুলোর মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখন তাদের ফার্মেসিতে পানিবাহিত রোগের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে অন্য সময়ের চাইতে তুলনামূলক বেশি। হাকালুকি হাওরতীরের ভুকশিমইল ইউপি’র সাদীপুর, মীরশংকর ও গৌরিশংকর; জুড়ীর জায়ফরনগর ইউপি’র বেলাগাঁও, শাহপুরসহ বড়লেখার তালিমপুর ও সুজানগরে দেখা গেছে ভুক্তভোগীদের দৈন্যদশা। তাদের মতে, এমন দুর্দশায় পড়েছে ৩ উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের ২ শতাধিক গ্রাম। বিশেষ করে হাওরপাড়ের জেলেপল্লী হিসেবে পরিচিত সাদীপুর গ্রামের অনেকের রান্নাঘরের পাশে দেখা গেলো বন্যার পানিতে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ আর অস্বাস্থ্যকর খোলা পায়খানা। আর বিশুদ্ধ পানির উৎস টিউবওয়েল খুবই কম। বানের পানি বসতঘরের ভেতর ও বাহিরে। অনেকেই ঘরের খাটেই বিশেষ কৌশলে রান্নাবান্না চালাচ্ছেন। আর ওখানেই নিয়েছেন নিরাপদ ঠাঁইও। বন্যার কারণে এখন তাদের বিশুদ্ধ খাবার পানি, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন যেমন নেই। তেমনি অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় বতসবাড়ির পরিবেশও। এমন পরিবেশই জানান দিচ্ছে তাদের পানিবাহিত রোগে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি।

বানভাসী মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন সত্যকাম চক্রবর্ত্তী জানান, এবার অকাল বন্যায় বোরো ধান পচে হাওরের পানি দূষিত হওয়ার পর একাধিকবার বন্যা হয়েছে। সর্বশেষ ৩য় দফার বন্যায় এসব এলাকার টিউবওয়েল ও স্যানিটেশন বিপর্যস্ত হয়েছে। তাই পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। এ ব্যাপারে আমরা অবগত আছি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদেরকে সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।