এই বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বের সকল দেশ যখন নিজেদের শক্তিমত্তার প্রদর্শনিতে মত্ত ছিল টিক তখনি COVID-19 নামক ভাইরাসটি এসে সকল শক্তিকে পিছনে ফেলে তার শক্তি জানান দিতে লাগলো। যার ব্যাপকতা শুরু হয়েছিল সূদুর চীন থেকে কিন্তু বিশ্বের প্রায় সব দেশে এর বিস্তার লাভ করতে বেশি সময় নেয়নি। দেশ থেকে দেশে ছড়াতে লাগলো ভাইরাসটি আর এই ভাইরাসের কবল থেকে রেহাই পায়নি উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত কোনো দেশই। কিছু দিনের মধ্যে সবকিছু ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে সবার উপরে জায়গা করে নিল করোনাভাইরাস এর খবর। বিশ্বব্যাপী দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ল প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চীনের উহান প্রদেশে খুব কঠিন ভাবে লকডাউন কার্যকর করা হলো। তারা লকাডাউনের সুফল ও পেতে থাকলো। দিন যত বাড়ছে ভাইরাসটির ব্যাপ্তি বাড়তে শুরু করল। বিশ্বের শক্তিধর দেশ গুলোর পাশাপাশি মধ্যম আয়ের দেশ, আনুন্নত দেশ গুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এই কঠিন ভাইরাস।

মার্চ মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের অস্থিত্ব খোজে পাওয়া যায়। তখনো বাংলাদেশের বিমানবন্দর, স্থলবন্দর সহ সকল বন্দর গুলো খোলা ছিল। প্রবাসীরা দেশে আসছেন কিন্তু কঠিন ভাবে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হয়নি। এতে করে দেশের ভিতরে করোনার প্রকোপ বাড়তে লাগলো। আর সাথে সাথে আমাদের কংকালসার স্বাস্থ্য খাতের চিত্র ফুটে উঠতে লাগলো। আমাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য আসতে শুরু করল কিন্তু তাদের কথা আর কাজের মধ্যে কোনো মিল খোজে পাওয়া যায়নি। অবশেষে প্রথমে স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হলো, পরে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সারা দেশকে লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসা হলো। লকডাউন নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হল। এই লকডাউন কয়েক ধাপে বাড়ানো হল। কিন্তু আমরা জাতিগত ভাবে কিছুটা বিশৃঙ্খল জাতি তাই লকডাউনকে ছুটি মনে করে অনেকে অনেক জায়গায় ঘুরতেও গেছেন। আবার অনেকে লকডাউন কি তা দেখতে বের হয়েছেন। কেউ কেউ সেনাবাহিনী কি করে দেখার জন্য রাস্তায় অপেক্ষমান আবার সেনাবাহিনীকে দেখার পর দৌড়। এভাবে চলতে থাকলো আর দেশের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। দেশের এই পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ আর মধ্যবিত্তদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য চারিদিকে হাহাকার শুরু হলো।

মধ্যবিত্ত শব্দটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। মধ্যবিত্ত জীবনের কি যে কষ্ট তা শুধু মধ্যবিত্তরাই জানে। তাদেরকে সমাজের সব শ্রেণীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এই তাল মিলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় বা অনেক সময় অভিনয় করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। এই করোনাকালীন সময়ে সরকার থেকে এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সমিতি, ফোরাম, প্রবাসীদের উদ্যোগে, ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন মাধ্যমে সাহায্য সহযোগীতা করা হলো অসহায় সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের। কিন্তু এই মধ্যবিত্তদের খবর কি কেউ নিয়েছেন? হয়ত নিয়েছেন অনেকেই তবে তা সংখ্যায় খুবই নগন্য। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগলো। দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য যেন নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। মধ্যবিত্তরা এমনি হয়, না কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারে না নিজে টিকমত চলতে পারে। আর করোনা এসে যেন মধ্যবিত্তদের বিপদ শতগুনে বাড়িয়ে দিলো। ঘরবন্দী অবস্থায় ঠিকে থাকা যেন কঠিনতর হয়ে গেছে। আবার যারা ইট বালুর শহরে থাকেন তাদের জন্য বাড়িভাড়া মাথাব্যথার অন্যতম কারন। অনেকের আবার ছোট খাট চাকরি চলে গেছে, অথবা বেতন বন্ধ হয়ে গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্টানে কর্মী ছাটাই শুরু করে দিয়েছে করোনাকালীন সময়ের প্রথম থেকেই। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মধ্যবিত্তরা। আর বাড়িওয়ালাদের অমানবিক আচরণ আরও বেশি মনকষ্টের কারণ। সারা দেশে হাতে গুনা কয়েকজন বাড়িওয়ালা ব্যতীত আর কাউকেই মানবিক হতে দেখিনি এই মহাবিপদের সময়েও। এই সব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মধ্যবিত্ত পরিবার গুলো ইতিমধ্যে বাসাবাড়ি ছাড়তে শুরু করেছে বা তুলনামূলক কম ভাড়ার বাসায় উঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করে অনেকের অনেক দিনের পুরোনো অস্থায়ী ঠিকানা আবার পরিবর্তন হচ্ছে। এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি জর্জরিত হচ্ছে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে মেস ভাড়া করে থাকা আমাদের ছাত্র সমাজ সহ ব্যাচেলর ছোটখাটো চাকুরীজীবিরা। আমি নিজেও এক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান আর আমিও একি কারনে ভুক্তভোগী। তাই আগামী মাস থেকে সিলেট শহরের প্রায় ১০ বছরের পুরোনো ঠিকানা বদলিয়ে আগামী মাস হতে নতুন ঠিকানায় ঠাই নিতে হচ্ছে। এরকম হাজারো মধ্যবিত্তের ঠিকানা বদল হচ্ছে আবার তার বিপরীতে অনেকে টিকতে না পেরে শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমাচ্ছে। অনেকেই চাকরি হারিয়ে মাথার উপরে যেন আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গুলো বিশেষ করে প্রাইভেট স্কুল কলেজের শিক্ষকদের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। মানুষ গড়ার কারিগরদের আজ রাস্তায় বসার মত অবস্থা। আবার অনেক প্রতিষ্টানে প্রায় অর্ধেক বেতন কেটে নেওয়া হচ্ছে। এই করোনাকালীন সময়ে আমাদের সামনের সারির যোদ্ধা যারা তাদের বেলায়ও অবস্থা অনেক জায়গায় সমান, প্রাইভেট অনেক মেডিকেলের ডাক্তারদের অর্ধেক বেতন দেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থায় আমাদের সমাজে একটি কঠিন বিপর্যয় নেমে এসেছে।

রাজধানী ঢাকা শহরের বাড়িওয়ালাদের কয়েকটি অমানবিক আচরণ আপনাদের সাথে শেয়ার করি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে দেখতে পেলাম ঢাকা শহরের ধানমন্ডী এলাকার এক বাড়িওয়ালা, কয়েকজন ছাত্র মেস করে উনার বাসায় ভাড়া থাকত। এই করোনাকালীন সময়ে সবাই বাড়িতে চলে যায়। মাসের ভাড়া দিতে তাদের কিছুটা বিলম্ব হচ্ছিল। এমতাবস্থায় ঐ বাড়ির মালিক তাদের না জানিয়ে বাসার সমস্ত জিনিস পত্র সিটি কর্পোরেশন এর ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেন যার মধ্যে ছিল ঐসব ছাত্রদের জীবনে অর্জিত সার্টিফিকেট সহ অনেক জরুরি কাগজপত্র। এই ঘটনা শুধু অমানবিক নয় রীতিমতো জঘন্য কাজ।এই ঘটনার খবর পেয়ে ছাত্ররা ছুটে আসে নিজ নিজ জেলা শহর থেকে এসে এই অবস্থা দেখে তারা হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।আর একটি ঘটনা দেখলাম একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল থেকে বিনা নোটিশে প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্রদের বের করে দেওয়া হয়েছে। আরও করুণ একটি ঘটনা বলি এক ডাক্তার দম্পতি থাকতেন রাজধানীতেই এক বাসাতে। বাসার মালিক যখন জানতে পারলেন এই ডাক্তার দম্পতি করোনা চিকিৎসা দিচ্ছেন উনি রাতের বেলা তাদেরকে বাসা থেকে বের করে দিলেন এবং রাতের খাবারটা পর্যন্ত খাওয়ার সময় দেন নাই ঐ দম্পতিকে। মজার বিষয় হচ্ছে আমরা সবাই জানি মাত্র কিছুদিন আগে ৩৮তম বি.সি.এস এর রিজাল্ট বের হয়েছে এই রিজাল্টে ডাঃ সেওতি প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। এই খবর জানার পর চাইলেও কোনো বাড়িওয়ালা কি উনাকে এই ভাবে বের করে দিতে পারবে? জানি পারবে না। এভাবেই চলতেছে মধ্যবিত্তদের জীবন।

হাজারো স্বপ্ন নিয়ে শহরে আসা মানুষ গুলো আজ সকল স্বপ্নকে পিছনে ফেলে জীবন বাচানোর তাগিদে আগের স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে যাচ্ছে। অন্তত নিজের ভিটেমাটিতে থেকে দুবেলা দুমুঠো খাবারের আশায়। আবার অনেকে তাদের ঠিকানা বদলিয়ে মাথা গোজার ঠাই করে নিচ্ছে নিম্ন মানের বাসা বাড়িতে। এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপদের সম্মুখীন হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। রাজধানীতে ভাড়া বাসায় থাকেন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। ইতিমধ্যে একটি রিপোর্টে দেখা গেছে শুধু রাজধানী শহর থেকেই প্রায় ১ লাখ পরিবার গ্রামে ফিরে গেছে এবং প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে বাড়িতে বাড়িতে টুলেট লিখা সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যাচ্ছে প্রায় সর্বোত্রই। অনেক শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। তারা অনেকে টিউশন করে আবার অনেকে পাশাপাশি ছোট খাটো জব করে নিজেদের খরচ চালিয়ে নিত কিন্তু তা আর কোন ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। যারা ব্যবসা বাণিজ্য করত তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই মধ্যবিত্তদের অবদান ব্যাপক। আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে এই মধ্যবিত্তরাই দিন রাত পরিশ্রম করে যান।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ( বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে করোনাভাইরাসের প্রভাবে চাকরি হারিয়েছেন ১৩ শতাংশ মানুষ এবং আয় কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের। অপরদিকে বেসরকারি সংস্থা ব্রাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে চাকরি হারিয়েছেন ৩৬ শতাংশ মানুষ। আর ৩ শতাংশ মানুষের চাকরি থাকলেও বেতন পাচ্ছেন না। দেশের এই সংকট কত দিন চলবে তা বলা মুশকিল। এই কঠিন পরিস্থিতিতে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত তথা সাধারণ মানুষকে বাচিয়ে রাখার জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করার মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞগণ। আমরাও আশাকরি সরকার এই দিকে নজর দিবে এবং জীবন মান উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

পরিশেষে আসুন আমরা সবাই বৈশ্বিক এই মহামারীতে একে অপরের পাশে দাঁড়াই। অন্তত পক্ষে আমরা একে অন্যের প্রতি মানবিক হই। সবার সাথেই মানবিক আচরণ করি। বিশেষ করে বাড়িওয়ালা যারা আছেন দয়া করে ভাড়াটিয়াদের প্রতি মানবিক আচরণ করবেন এই প্রত্যাশা করি। ইনশাআল্লাহ আলো আসবেই, আমাদের বাংলাদেশেরই একটি প্রতিষ্টান করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই গবেষক টিমের প্রতি এবং ড. আসিফ মাহমুদের প্রতি শুভকামনা থাকলো। আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতের অপেক্ষায় থাকলাম। আবার পৃথিবী আগের মতই স্বাভাবিক হবে আমরাও আমাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবো এই প্রত্যাশাই করি।

করোনা- বিয়ানীবাজারে আরও ৩জন আক্রান্ত