শিক্ষার্থীরা সাধারণত স্বপ্ন দেখেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতেন টিকে থাকার। পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেকে টিকিয়ে রাখার। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনাকে বন্ধু মনে করে এগিয়েছেন তিনি। সংসারে অভাবের কারণে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকতে হয়েছে অন্যের বাড়িতে। এখন তিনি বিশ্বের নাম করা একজন বিজ্ঞানী। তিনি এমন একটি প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন যার মাধ্যমে মাত্র ৯০ মিনিটে মরণব্যাধি ক্যানসার যাচাই করা যায়।

বলছিলাম সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী গ্রামের কৃষক বাবার সন্তান বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকীর কথা। তিনি ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকারের ৩ লাখ ৭৫ হাজার ডলারের অনুদান পেয়েই প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণের একটি সহজলভ্য পদ্ধতি আবিষ্কারে কাজ শুরু করেন।

ড. জহিরুল আলম সিদ্দিকীর শৈশবকাল খুব বেশি সুখের ছিল না। সে সময় তাদের সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেই তার পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়। সাত মাস কেটে গিয়েছিল, কোথাও ভর্তি হতে পারেননি। সেই সময় পরিবারে বড় ধরনের একটা সমস্যা হয়েছিল। জহিরুল আলম তখনই ভেবে নিয়েছিলেন পড়াশোনা মনে হয় এখানেই শেষ। কিন্তু জহিরুল আলমের মা তার এক চাচাতো ভাইয়ের মাধ্যমে তাকে গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বাদশাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করান।

সেখানে নিজগাবী নামক গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে থেকে দুই বছর পড়াশোনা করেছেন তিনি। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর একটি সমস্যার কারণে আরও এক বছর তার পড়াশোনা বন্ধ রাখতে হয়। তখন তার বড় ভাই আজহারুল ইসলাম সিদ্দিকি দায়িত্ব নিলেন তার পড়াশোনার। সিলেট গিয়ে দুই-একজন ছাত্রকে পড়ানোর বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয় তার। ভর্তি হন মোগলবাজার রেবতি রমন হাইস্কুলে। সেখান থেকেই ১৯৯৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেন। বলা হয় ওই স্কুলের তখন পর্যন্ত সেরা রেজাল্ট জহিরুল আলম সিদ্দিকীর।

এরপর ভর্তি হন সিলেটের এমসি কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করার পর পড়াশোনা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের শেষ করার পর দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমান পিএইচডি করার জন্য। তার পিএইচডি গবেষণাপত্র পৃথিবীর নাম করা সব জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। পিএইচডি শেষে পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসেবে কাজ করেন অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডে রিসার্চ ফেলো হিসেবে ছয় বছর কাজ করার পর ২০১৫ সাল থেকে গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। পাশাপাশি তিনি গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার।

বিজ্ঞানী ড. জহিরুল আলম সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, আমি যেহেতু রসায়ন নিয়েই বেশি পড়াশোনা করেছি তাই আমার ইচ্ছা ছিল এটা নিয়েই করার। আমি অতীতে আমার অনেক আত্মীয়কে দেখেছি ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে। ক্যানসার আক্রান্ত হলে চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সবার পক্ষে সম্ভব না। তাই আমি ২০১২ সাল থেকে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি এবং সাফল্যও এসেছে। আমরা এখন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছি যেটি দিয়ে মাত্র ৯০ মিনিটে ক্যানসার ডিডেক্ট (শনাক্ত) করা যায়।

এই প্রযুক্তির কাজের বিষয়ে তিনি বলেন, যন্ত্রটিতে আমরা বেশ কিছু মেটালিক-ম্যাগনেটিক ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহার করেছি। সেগুলোর সঙ্গে ক্যানসার শনাক্ত করতে সক্ষম বায়োমার্কার সংযুক্ত করা হয়েছে। বায়োমার্কারের উপাদানগুলো নির্ধারিত জৈব উপাদানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এই উপাদানকে রক্ত, লালা কিংবা মূত্রের সঙ্গে মেশানো হলে রোগীর শরীরে যদি ক্যানসারের কোষ থাকে তাহলে সেগুলো বায়োমার্কারের উপাদানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এরপর ম্যাগনেটিক প্রভাব ব্যবহার করে রক্তের বাকি উপাদানগুলো থেকে এই পার্টিকেলগুলো আলাদা করে ফেলা হয়। এই পর্যায়ে কিছু অতিরিক্ত নির্দেশক ফ্লুইড ব্যবহার করলেই উপাদানের রং বদলে যাবে। এটা থেকে অনায়াসেই ক্যানসারের কোষ ওই রক্তে আছে কি-না বোঝা যাবে। এ ছাড়া রঙের মাত্রার ওপর নির্ভর করে ক্যানসারের ধাপ সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া সম্ভব, তাও মাত্র ৮০-৯০ মিনিটের মধ্যে।

ড. জহিরুল আলম সিদ্দিকী বলেন, এই প্রযুক্তির সুবিধা হচ্ছে এটা দিয়ে দ্রুত ক্যানসার শনাক্ত করা যায়। ক্যানসার যদি দ্রুত আমরা জেনে নিতে পারি তাহলে এটার চিকিৎসাও দ্রুত সম্ভব হবে। দ্রুত চিকিৎসা শুরু হলে সেটা থেকে খুব দ্রুত নিরাময় হবে। যদি কোনো রানিং ক্যানসার রোগীকে এটা দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং ক্যানসার সেল শনাক্ত হয় তাহলে বিভিন্ন থেরাপি কীভাবে যাবে, কখন যাবে এবং সেটি ঠিকমতো কাজ করছে কি-না সেটি সম্পর্কে জানা যাবে। এটার সুফল দিক অনেক, খারাপ দিক নেই। কারণ এটি মানুষের কল্যাণে কাজ করছে।

খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যানসার শনাক্ত করার জন্য যদি পুরোনো পদ্ধতি আমরা ব্যবহার করি, তাহলে খরচ পড়বে ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। সেখানে হয়তো ৫০০ টাকার একটা সামান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগী নিজেই ঘরে বসে ক্যানসার শনাক্ত করতে পারবে। এ ছাড়া এটি দিয়ে গ্লুকোজের পরিমাপ, রক্তের বিভিন্ন উপাদান নির্ণয়েও বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া চেকআপের জন্য এ রকম একটি সহজলভ্য যন্ত্র ব্যবহার করা হলে আমাদের চিকিৎসা সেবায় বিশাল বিপ্লব ঘটবে। এতে রোগী নিজ থেকে তার রোগ সম্পর্কে সচেতন হবে। আর প্রাথমিকভাবে যদি ক্যান্সার শনাক্ত হয় তাহলে এটি নিরাময়ও দ্রুত সম্ভব।

বর্তমান তরুণদের উদ্দেশে ড. জহিরুল আলম সিদ্দিকী বলেন, আমাদের দেশে এখন অনেক ভালো সুযোগ আছে। তার জন্য আমাদের প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। আমাদের যে যে বিষয়ে কাজ করা সুযোগ রয়েছে সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। সবকিছুর মূল হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম ও ডিটারমাইন্ড। কোনো কাজ করতে গেলে দ্রুততার সঙ্গে করা যাবে না , দেশকে ভালোবাসতে হবে।

শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য বিদেশ গিয়ে কোন আর দেশে ফিরে আসেন না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থীই আসতে চায়, কিন্তু তাদের সেইভাবে মূল্যায়ন করা হয় না বা সুযোগ দেয়া হয় না। পিএইচডি আছে, ভালো ডিগ্রি আছে তারা দেশে আসলে ভালো চাকরি দেয়া হয় না। তাই আমার দেশের সম্পদকে যদি দেশেই রাখতে হয় তাহলে তাদের সুযোগ করে দিতে হবে।

সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদের বিষয়ে ড. জহিরুল আলম সিদ্দিকী বলেন, এটি সত্যিই সুনামগঞ্জের মানুষের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুব ভালো খবর। যদি এটি হয় তাহলে আমাদের হাওরের ছেলে-মেয়েরা বেশি উপকার পাবে। আমাকে যদি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর ক্লাস করানোর জন্য বলা হলে আমি দেশে আসলে অবশ্যই ক্লাস নিব। কারণ আমি আমার দেশকে অনেক ভালোবাসি। আমি বিদেশে থাকলেও এই দেশের চিন্তায় থাকি সবসময়।

তথ্যসূত্র- জাগোনিউজ২৪।