প্রযুক্তির আবিষ্কার মানুষের জীবনাচারকে সহজ করে দিয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন হয় মানুষের প্রচেষ্টার ফলে। স্টীম ইঞ্জিনের আবিষ্কার শুধু যে উৎপাদনের গতি বাড়িয়েছে তা নয়; বরং মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও গতি এনেছে। একইভাবে একবিংশ শতকের প্রারম্ভেই যে বিষয়টি মানুষের মনন ও চিন্তার প্রধান অংশটা জুড়ে আছে তা হলো কম্পিউটার। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইন্টানেটের আবিষ্কার পৃথিবীকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। ১৯৯৫ সালের পর থেকে ইন্টারনেটকে যখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা শুরু হয় তখন থেকেই তাবৎ দুনিয়ার চেহারায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ কিশোর, যুবক এমনকি বৃদ্ধদের হাতে হাতে স্মার্টফোন সাথে তো ইন্টারনেট আছেই। স্মার্টফোন বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনের এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট বিহীন স্মার্টফোন একেবারেই অর্থহীন আবার স্মার্টফোনবিহীন ইন্টারনেট সময়ক্ষেপন; আগবাড়িয়ে অচলও বলা যায়।

একটি ইন্টারনেটসহ স্মার্টফোন থাকলে একজন রাজনীতিবিদ দেশের এবং দেশের বাইরের রাজনীতির সব খবর মুহূর্তের মধ্যেই জানতে পারছেন। একইভাবে, একজন সংস্কৃতিকর্মী জানতে পারছেন দেশে-বিদেশের সংস্কৃতির সকল তথ্য। ছাত্র-ছাত্রীদের এসাইনমেন্ট তৈরীতে বেশ দৌড় ঝাপ করতে হয় না। শুধু তাই নয় গৃহিনীরা বাহারী স্বাদের খাবার তৈরী করছেন ইন্টারনেট ঘেটে ঘেটে। এক কথায় ইন্টারনেটসহ স্মার্টফোন হাতের মুটে থাকা মানে গোটা বিশ্ব ব্রহ্মা- হাতের মুটে থাকা। সেই জন্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুফল এতো স্বল্প আলোচনায় শেষ করা অসম্ভব।

কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির এ ছোঁয়ায় জনজীবনে গতিশীলতা আনলেও এর অপব্যবহারের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আরো বেশী। “বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটির বেশী জনসংখ্যার মধ্যে ৩০ শতাংশ মানুষ এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটি মানুষের হাতে আছে স্মার্টফোন। মুঠোফোন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, আগামী পাঁচ বছরে এ সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছাবে। অর্থ্যাৎ প্রায় ১০ কোটি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করবে।” (২৬ জানুয়ারি ২০১৮, একুশে টিভি অনলাইন, সোলায়মান শাওন)। তবে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার দিনি দিন আসক্তির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং শিশুদের মধ্যে অনেকটা ‘মাদকাসক্তির’ মতই প্রভাব ফেলছে বিষয়টি।

আসক্তির জগতে ‘ইন্টারনেট আসক্তি’ হলো সবচেয়ে আধুনিক সংযোজন। কথা হলো কখন একে আসক্তি বা এডিকশন বলা যায়। যেহেতু এডিকশন একটি মানসিক ব্যাধি, কাজেই যে কোন কিছু এডিকশন হতে গেলেই তাকে কতগুলো ডিসঅর্ডার ক্রাইটেরিয়া বা শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন, (১) ইন্টারনেটে আসক্ত রোগীর চিন্তা চেতনায় সারাক্ষণ শুধু ইন্টারনেট বিরাজ করবে; এর বিভিন্ন মাধ্যমে সে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে; এটা হতে পারে ফেসবুক, পর্নোগ্রাফি, গেইমিং, অলনাইন গেমলিং বা জুয়া ইত্যাদি অর্থ্যাৎ যা কিছু ইন্টারনেটের মাধ্যমে করা সম্ভব। (২) ব্যক্তির জীবনের প্রধান আকর্ষণ, কর্মকান্ডই হবে ইন্টারনেটকে ঘিরে; ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হলে রোগীর মধ্যে বিরক্তি, উদ্বেগ, বিষন্নতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেবে। অল্প বয়সী টিনএজারদের ক্ষেত্রে জোর করে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে রাগারাগি, ভাংচুর ইত্যাদি আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে কোন বয়সেই এই ইন্টারনেট আসক্তি দেখা দিতে পারে। তবে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশী দেখা যায় অল্প-বয়সী টিনএজ ছেলে মেয়েদের মধ্যে। (ডা: আহসান উদ্দিন, যুগান্তর পত্রিকা, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোর মধ্যে ফেসবুক বেশী জনপ্রিয়।

ফেসবুকিং করেই অধিকাংশ সময় নষ্ট করেনআমাদের কিশোর, যুবক-তরুন, বৃদ্ধরা। এতে করে ছাত্র-ছাত্রীরা লেখা-পড়ায় আনন্দ খুঁজে পায় না। রাত জেগে অনলাইনে থাকার কারনে ক্লাসে যথাসময়ে উপস্থিত থাকতে পারে না। আবার ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও শ্রেণীকক্ষে মনোযোগ থাকেনা। চাকরিজীবীরা কর্মস্থলে সঠিকভাবে কর্ম সম্পাদন করতে পারেন না। বন্ধুদের আড্ডা আগের মতো আর জমে উঠে না। বন্ধুরা নির্দিষ্ট জায়গায় মিলিত হন ঠিকই কিন্তু প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্মার্টফোনে ফেইসবুকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এতে পারস্পরিক আন্তরিকতা কমে যায়। একসময় মানুষ তার আবেগ অনুভূতি কষ্টের কথা একান্ত আপনজনের কাছে শেয়ার করে হালকা অনুভব করত। কিন্তু এখন দেখা যায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মনের অজানা কষ্ট, দুঃখ, সুখ, ব্যথা ইত্যাদি গোটা দুনিয়াকে জানান দিচ্ছে। নিজে কখন কোথায় কিভাবে সময় কাটাচ্ছে তাও গোপন রাখছে না মানুষ। অবাক করা বিষয় আপন মৃত মায়ের কবর জিয়ারতের পিকচার তুলে ফেসবুকে আপলোড দিচ্ছে। কুরবানীর জবাই করা গরুর উপর বসে দাঁত বের করে হেসে ছবি তুলছে। সেই ছবি স্যোসাল মিডিয়ায় শেয়ার করে লাইক ও কমেন্টের আশা করছে বিচিত্র এই মানুষজন।

সহসাই এই সব কর্মকান্ডকে এডিকশন বলা যায়। জুয়াড়িদের সঙ্গেঁ ইন্টারনেট এডিকশনের একটা মিল পাওয়া গেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পরিচালিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায়। দেখা গেছে প্রতিদিন যারা চার বা তার বেশী সময় ধরে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের ডোপানিন নামের রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায় মস্তিষ্কে। জুয়াড়িদের শরীরেও দেখা যায় একই ধরনের পরিবর্তন। অর্থ্যাৎ কেবল মানসিক নয়, শরীরিক রসায়নের দিক থেকেও এ দুটো দল অনেক কাছাকাছি।

জুয়াড়িদের আসক্তি নির্ণয়ের জন্য আমেরিকায় যে ধরনের মেডিকেল টেস্ট প্রচলিত আছে তার ধাচে তৈরী করা রয়েছে ইন্টারনেট এডিক্টদের জন্য প্রথম মেডিকেল টেস্টের খসড়া। জুয়াড়িদের নেশার ধরন আর ইন্টারনেট আসক্তিকে মেলানোর পেছনে বেশ কিন্তু যুক্তি তুলে ধরেছেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. কিমবার্লি ইয়ং। এই মনোবিজ্ঞানী খুজঁ নিয়ে দেখেছেন, আদতে এ দুটোই হলো ইমপালস্ কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার (ওঈউ)। মনের তাগিত মেটাতেই এখানে সব কিছু করতে বাধ্য হয় মানুষ। কোনো নেশাদ্রব্যের কারণে নয়। জুয়ার আসক্ত কোন লোক যেভাবে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে জুয়া খেলে সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলে সেই একই বিষয় ঘটে ইন্টারনেট আসক্তদের ক্ষেত্রেও। (শামীম তুষার, সময় প্রকাশন, ২০০২, পৃষ্টা-৫০) চিকিৎসকরা বলছেন, মুঠোফোন ব্যবহারের কারণে মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যঝুকি দিন দিন বেড়েই চলছে। অতরিক্ত মুঠোফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে মানুুষের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।

ভারতের জাসলক হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্রর সার্জন সঞ্চয় রায় এক গবেষণাপত্রে বলেন, সেলফোন ব্যবহারকারী অনেকেরই ফোনের প্রতি এক ধরনের আসক্তি তৈরী হয় যার ফলে সময় মতো খাবার খাওয়া বা ভ্রমণ করার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ থাকে না। অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের জন্যও শরীরের ওজন বৃদ্ধি পায় এবং নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়ে এই সমস্যায় বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে যে সকল শারীরিক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় তা হলো- ঘাড় ব্যাথা, মাজা ব্যাথা, মাথা ব্যাথা এবং চোখে অস্বাভাবিক চাপজনিত সমস্যা (ঊুব ঝঃবধৎরহ) ইত্যাদি। এছাড়া অনিদ্রা, অতিরিক্ত টেনশন বোধ, বিষন্নতা, যৌন সমস্যা, অপরাধ প্রবণতা এবং যেকোন কিছুতে মনোযোগ কমে যাওয়া ইত্যাদি মানসিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। একইভাবে ফেইসবুক চ্যাটিং ও সাইবার সেক্স দাম্পত্য কলহের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা সহজেই অনাকাঙ্খিত পারস্পরিক বিভিন্ন সর্ম্পকে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। পারিবারিক অশান্তি তৈরীতে এই ধরনের কর্মকান্ড খুব বেশী ভূমিকা পালন করছে। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে।
বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশী জাতি কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হবে। তাই এই দুর্বৃত্ত থেকে আমাদের দ্রুত বের হয়ে আসতে হবে।

যেহেতু মনোবিজ্ঞানীরা ইন্টারনেট এডিকশনকে রোগ হিসেবে চি‎ি‎হত করেছেন সেহেতু এর চিকিৎসা পদ্ধতিকে তিনভাগে ভাগ করেছেন- সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা, ফিজিক্যাল চিকিৎসা এবং সোস্যাল চিকিৎসা।

সাইকোলজিকাল চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা রোগীকে ইন্টারনেটের কুফল সম্পর্কে জ্ঞান দান করেন। ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন। ইন্টারনেটে আনন্দ না খুঁজে বাস্তব জীবন থেকে আনন্দ বের করার পরামর্শ দেন, যেমন- গল্প করা, আড্ডা দেয়া, বাগান করা, বেড়ানো, বই পড়া, ধর্মীয় পুস্তক চর্চা করা ইত্যাদি।(ডাঃ হারুনুর রশীদ, যুগান্তর পত্রিকা, ১৭ নভেম্বর ২০১৮) অন্যদিকে ফিজিক্যাল চিকিৎসার বেলায় চিকিৎসকরা বিভিন্ন ঔষধপত্র দিয়ে থাকেন। আবার সোস্যাল চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা পরিবারকে অধিক সময় দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এছাড়া নিয়মিত আউটডোর গেমস, যেমন- ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্যান্য খেলা যাতে শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় সেগুলোতে অংশগ্রহণ করা; পারিবারিক বন্ধন এবং সম্পর্ককে সুদৃঢ় করা, পারস্পরিক সম্পর্কের যতœ ও পরিচর্যা করা শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করা যেখানে ইন্টানেটের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারও অর্ন্তভূক্ত থাকবে।

ইন্টারনেট ব্যতীত বর্তমান যুগে চলা অসম্ভব। কিন্তু ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি অন্যান্য নেশার মতোই একটি নেশা যা ব্যক্তির সামাজিক পারিবারিক ও পেশাগত জীবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, “বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এর ব্যবহার যেন সঠিক এবং ভালো কাজে লাগে সেদিকে আমাদের সচেতন হতে হবে।” সুতরাং সব কিছুরই ভালো এবং মন্দ দুই দিক থাকে। প্রযুক্তিরও খারাপ দিক রয়েছে। সেটিকে ভালভাবে ব্যবহার করার দায়িত্ব আমাদেরই।

লেখক- প্রভাষক (সমাজবিজ্ঞান), আছিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ।
প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সচিব ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক- শিক্ষা উন্নয়ন ট্রাস্ট, বিয়ানীবাজার।
সদস্য, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন, বিয়ানীবাজার উপজেলা, সিলেট।