এমসি কলেজে গৃহবধূ গণধর্ষণসহ সিলেট বিভাগে গেলো বছর ৩২৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর আগের বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৩৫১ নারী। আগের বছরের তুলনায় গেলো বছর ২৮টি ধর্ষণের ঘটনা কমেছে। পুলিশ সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

নারী নির্যাতন নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনের দায়িত্বশীলরা বলেছেন, বাস্তবতার সাথে পুলিশের তথ্যের মিল নেই। কারণ, ধর্ষণের অনেক ঘটনা গোপনেই নিষ্পত্তি হয়ে যায়। সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের পুলিশ সুপার (ক্রাইম এনালাইসিস ও মিডিয়া) মো. জেদান আল মুসা বলেছেন, পুলিশের তৎপরতার কারণে ধর্ষণের মামলা কিছুটা হলেও কমেছে। সমাজের সকলের কার্যকর ভূমিকা থাকলে আগামীতে আরো কমে আসবে।

পুলিশ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের ৪ জেলা ও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) মিলিয়ে গত বছর ৩২৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে সিলেট মহানগর পুলিশ এসএমপি’তে ৯৮টি ও সিলেট রেঞ্জের সকল থানা মিলে ২২৫টি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। এর আগের বছর ২০১৯ সালে ধর্ষণ মামলার মোট সংখ্যা ছিল ৩৫১টি।

এর মধ্যে এসএমপি’তে ৯৭টি ও সিলেট রেঞ্জে ২৫৪টি মামলা রেকর্ড হয়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে আগের বছরের তুলনায় গত বছর মামলা কমেছে ২৮টি। অবশ্য এসএমপিতে আগেরবারের তুলনায় গত বছর ১টি মামলা বেড়েছে। প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় পৃথক মামলা গ্রহণ করে পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি)-এর ৬ থানায় ৯৮টি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড হয়। এর মধ্যে এমসি কলেজের হোস্টেলে গৃহবধূকে জোরপূর্বক তুলে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের গণধর্ষণের ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচিত হয়। সিলেট-ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিক্ষুব্ধ লোকজন ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় নামেন। একই সাথে ধর্ষকদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড করার বিধান করতেও দাবি জানান আন্দোলনকারী লোকজন। এক পর্যায়ে ধর্ষণ আইনের সংশোধন করে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাশ হয়। বর্তমানে বহুল আলোচিত এই মামলাটি সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে ।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিলেট রেঞ্জ পুলিশের অধীনস্থ ৪ জেলার ৩৯টি থানায় গত বছর ২২৫টি মামলা রেকর্ড হয়। এর আগের বছর মামলার সংখ্যা ছিল ২৫৪টি। সিলেট জেলায় (এসএমপি ছাড়া) গত বছর ৮৩টি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। এর আগের বছর ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৬১টি। এ হিসেবে আগের বছরের তুলনায় গত বছর সিলেট জেলায় ২২টি ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। মৌলভীবাজার জেলায় গত বছর ১৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর আগের বছর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ২৭টি।

তুলনামূলকভাবে আগেরবারের তুলনায় গত বছর ৮টি ধর্ষণের ঘটনা কমেছে। হবিগঞ্জ জেলায় গত বছর ৭৫টি ধর্ষণের ঘটনায় থানায় মামলা রেকর্ড হয়। আগের বছর ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছিল ৯৪টি। এ হিসেবে আগের বছরের তুলনায় গত বছর হবিগঞ্জ জেলায় ধর্ষণের মামলা কমেছে ১৯টি। সুনামগঞ্জ জেলায় গেলো বছর ৪৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর আগের বছর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৭২টি। তুলনামূলকভাবে আগের বছরের তুলনায় গত বছর সুনামগঞ্জ জেলায় ২৪টি ধর্ষণের ঘটনা কমেছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, মৌলভীবাজার জেলা সদরে বন্ধুদের আড্ডায় মাদক সেবন করিয়ে এক ছাত্রনেতা তার বান্ধবীকে ধর্ষণের ঘটনাটি ছিল জেলা জুড়ে আলোচনায়। বিষয়টি নিয়ে জেলা সদরে নানা কর্মসূচিও পালিত হয়েছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের দায়েরকৃত মামলার হিসেব অনুযায়ী পুলিশ ধর্ষণের পরিসংখ্যান নির্ণয় করে। ঘটনা অবহিত হওয়ার পর পুলিশ আসামীদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করে। সূত্র জানায়, করোনাকালীন লক ডাউনের মধ্যেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হলেও লোকলজ্জার ভয়ে থানাপুলিশের নিকট বা মামলা-মোকদ্দমায় যাননি। যার ফলে অনেক ধর্ষণের ঘটনা আড়ালেই রয়ে গেছে। আবার অনেক ধর্ষণের ঘটনা চুপিসারে নিষ্পত্তি হওয়ায় পুলিশের নিকট এই খবরটি পর্যন্ত পৌঁছায়নি বলে জানা গেছে।

যৌন হয়রানি নির্মূলকরণ নেটওয়ার্ক সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের তথ্যের সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। কারণ হিসেবে তিনি জানান, অনেকে মান-সম্মানের ভয়ে থানায় কিংবা আদালতে যেতে চান না। অনেক ধর্ষণের ঘটনা গোপনেই শেষ হয়ে যায়। মাদক ধরতে পুলিশ যেভাবে সোর্স নিয়োগ করে ঠিক একইভাবে ধর্ষণের ঘটনায় খোঁজ পেতেও সোর্স নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। এতে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। করোনাকালেও যৌন হয়রানি-গণধর্ষণ বেড়েছে বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস এন্ড ট্রাস্ট-ব্লাস্ট সিলেটের সমন্বয়কারী এডভোকেট ইরফানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, করোনার জন্যে হয়তো ভয়ে অনেকেই অপরাধ থেকে বিরত থেকেছে। ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচার কম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা গেলে ধর্ষণের ঘটনা আরও কমে আসবে। আদালত সংকটের ফলে সিলেটে ধর্ষণ মামলাসহ নারী নির্যাতন মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি সিলেটে নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল বৃদ্ধির জন্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের পুলিশ সুপার (ক্রাইম এনালাইসিস ও মিডিয়া) মো. জেদান আল মুসা বলেন, ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুলিশ নানা কর্মসূচি পালন করে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারসহ নারীদের সুরক্ষায় পুলিশের নারী কর্মকর্তারা দিনরাত কাজ করেন। কোনো অপরাধী যাতে পার না পায় এজন্যে প্রত্যেকটি ধর্ষণ ঘটনার আসামীদেরকে গ্রেফতার করে আদালতে বিচারের মুখোমুখি করেছে। শুধু পুলিশ নয়, ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা জরুরি। বিশেষ করে পিতা-মাতা যদি তার সন্তানের প্রতি কঠোর হন তাহলে ধর্ষণসহ অনেক অপরাধই কমে আসবে।

সিলেট টু নিউইয়র্ক-জীবনের গল্প । পর্ব-৩