‘হে নতুন, দেখা দিক বার-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নিজের জন্ম দিন সম্পর্কে এই উক্তি করেছেন। এই উক্তি দিয়েই যে কোনো গুণী মানুষকেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো যেতে পারে। আজ ৫ জুলাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপির ৭৫তম জন্মদিন।

নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি ১৯৪৫ সালের ৫ জুলাই সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কসবা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। কসবা প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিয়ানীবাজার পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়, সিলেট এমসি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেটেছে তার শিক্ষাজীবন। নুরুল ইসলাম নাহিদের রয়েছে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে তৎকালীন ছাত্রনেতাদের মধ্যে যে ক’জন আজও রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় অবদান রাখছেন- নাহিদ তাদের মধ্যে অন্যতম। জাতীয় পর্যায়ে ষাটের দশকের সামরিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার দাবি, অধিকার অর্জন, গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ ওই সময়কালের সব আন্দোলন-সংগ্রামের একজন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি ছিলেন আন্দোলন সংগ্রামের প্রথম সারিতে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এবং তৎকালীন অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে গেরিলা বাহিনী সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও নুরুল ইসলাম নাহিদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকবাহিনীর দালাল খুনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ‘ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হিসেবে আন্দোলন ও গণআদালত সংগঠিত করাসহ নব্বইয়ের দশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা পুনরুজ্জীবিত করার ঐতিহাসিক সংগ্রামেও নুরুল ইসলাম নাহিদ বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯৩ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে পার্টি সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি পার্টির আদর্শগত শিক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে নুরুল ইসলাম নাহিদ সিপিবির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতে ঘুণগত পরিবর্তন দেখা দিলে বাস্তবতার বিবেচনায় ১৯৯৪ সালে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। বর্তমানে নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। এর পূর্বে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর তিনি আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী নরুল ইসলাম নাহিদ সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার) আসন থেকে ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ও ২০১৮ পরপর মোট চারবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদের সরকারে এক দশক (২০০৯-২০১৮) ধরে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তার সৎ ও সহজ-সরল জীবনযাপন বর্তমান সময়ে এ রাজনীতিক এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব হিসেবেই সবার কাছে প্রশংসিত। শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তার সময়ে বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ২০১০ সালে সর্বসম্মতিক্রমে প্রণীত হয় জাতীয় শিক্ষানীতি। কঠোর পরিশ্রম করে শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে তিনি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সাফল্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপুল প্রশংসা অর্জন করে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব ঐতিহ্য-সম্পদ হিসেবে’ স্বীকৃতি অর্জনে (৩০শে, অক্টোবর ২০১৭) নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি পরপর ২ বার সদস্য দেশসমূহের ভোটে ইউনেস্কোর সহ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ তিনি দুই বার ‘গ্লোবাল এওয়ার্ড অব ওয়ার্ল্ড এডুকেশন কংগ্রেস’ সম্মাননা লাভ করেন।

শিক্ষাঙ্গনের বাইরের বৃহত্তর সমাজে রয়েছে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। বিনয়ী ও নিরহঙ্কারী হিসেবে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি সৎ নিষ্কলষ্ক থাকায় সচেষ্ট, এমন স্বীকৃতি দিতে তার চরম প্রতিপক্ষও দ্বিধা করবে না।

২০০৯ সালে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো দায়িত্ব পেয়েই নুরুল ইসলাম নাহিদ দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরীর কাজে হাত দেন। এর উদ্যোগের ফলেই আমরা পেয়েছি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০। এ শিক্ষানীতির অনেক কিছুই কার্যকর হয়েছে এবং ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজ চলছে। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ এখন জাতীয় উৎসব। গত দশ বছরে এটি একটি অতুলনীয় সাফল্য। শিক্ষা বছরের শুরুর দিন শিক্ষার্থীরা ঝকঝকে নতুন বই হাতে পেয়েছে গত দশ বছর ধরে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তা সর্বজনবিদিত। প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে তা উচ্চ শিক্ষা স্তর পর্যন্ত ব্যাপ্ত। পাকিস্তান আমলে যেখানে সাক্ষারতার হার ছিল মাত্র ১৭ ভাগ তা বর্তমানে ৭৩ শতাংশে উন্নিত হয়েছে। দেশে স্কুলগামী শিশু ভর্তির হার প্রায় শতভাগ অর্জিত হয়েছে। ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। নারী শিক্ষার প্রসার বিশ্বজুড়ে আজ প্রশংসিত। তথ্য-প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্ব লাভ করছে। মাদ্রাসা শিক্ষার অনেকটা আধুনিকায়ন ঘটেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ গুরুত্ব সহকারে স্থান পেয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও অভাবনীয় উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্পন্ন গবেষণা ও কলেজ শিক্ষকদের উচ্চ প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সর্বজন গ্রহনযোগ্য ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণীত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এসব সাফল্যের সিংহভাগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদের সরকারের সময় অর্জিত হয়েছে। আর বিগত এক দশক (২০০৯-২০১৮) ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি।

নুরুল ইসলাম নাহিদ খুবই স্বজ্জন। তিনি একজন সুবক্তা ও সুলেখক। তাঁর বহু প্রবন্ধ ইতোমধ্যে প্রকাশিত এবং বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। কয়েকটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লক্ষ্য ও সংগ্রাম (২০০৯), রাজনীতির সুস্থধারা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম (২০১১), বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও গণতন্ত্রের পথপরিক্রমা (২০১০), শিক্ষানীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০০৯), শিক্ষা: লক্ষ্য অর্জনে যেতে হবে বহুদূর (২০১৫) ও রুখে দাড়াবার সময় (২০১৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার লেখার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সমসাময়িক সমাজ, শিক্ষা ও রাজনীতি। এসব লেখায় তার গভীর দেশপ্রেম, দরদী মন ও সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নের প্রকাশ লক্ষণীয়। তার রচিত এক দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী অর্জন, ২০০৯-২০১৮ গ্রন্থে আলোচ্য সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত নীতিমালা, এর প্রয়োগে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ, সেসবের বাস্তবায়ন চিত্র ও ফলাফল বিশদভাবে স্থান পেয়েছে।

তিনি শিক্ষামন্ত্রী থাকা অবস্থায় শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন এনেছেন। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের জন্য আধুনিক মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষার সুযোগ তৈরী হয়েছে। অন্যদিকে নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ, সততা, নিষ্ঠা, জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ দেশপ্রেমিক হতে উদ্বুদ্ধ করে শিক্ষার্থীদের আধুনিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলার লক্ষে তিনি ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। দুর্নীতিমুক্ত দক্ষ, স্বচ্ছ, গতিশীল শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলাসহ শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট করা, ঝরেপড়া বন্ধ করা ও শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষে গত দশ বছর তিনি ব্যাপক কাজ করেছেন।

২০১০ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষমন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ স্কুল ও মাদ্রাসায় সব ধরনের শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত ১৯ কোটি বই বিনামূল্যে যথাসয়ে পৌছে দিয়ে দেশবাসীকে বিস্মিত করেছিলেন।

নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি তিনি তার কাজ ও কর্মের মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। শ্রদ্ধেয়জন প্রিয় মানুষের ৭৫তম জন্মদিনে আত্মিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

লেখক পরিচিতি- সাংবাদিক ও ক্রীড়াভাষ্যকার।

৪ বছরেও শেষ হয়নি বিয়ানীবাজার-চন্দরপুর সড়কের দুর্ভোগ