প্রকাশ। ১২ মার্চ ২০১৭।

পথশিশু। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, “পথশিশু” শব্দটি ব্যবহার করার জন্য। কারণ এ বাক্যটি কারো জন্যই আর্শিবাদ নয় বরং অভিশাপ। এই সুবিধা বঞ্চিত অবহেলিত পথশিশুরা কি সমাজের জন্য অভিশাপ? আদর, স্নেহ, ভালোবাসা জড়িয়ে থাকা কথাটির নামই শিশু। পথশিশুর বৈশিষ্ট হলো- এরা খালি গায়ে, খালি পায়ে কিংবা ছেড়া জামা পড়ে ঘুরে বেড়ায়। পথে পড়ে থাকা বোতল, পলিথিন, ব্যবহৃত কাগজাদি কুড়ানোই ওদের কাজ।

এদের আবার বিশেষ নামও হয়ে থাকে। টোকাই, পিচ্চি, বাচ্ছু ইত্যাদি। পথ শিশুদের নিয়ে কত আয়োজন, প্রয়োজন জনে জনে কতজন শন শন, মাইকে ভন ভন করে। পত্রিকার পাতায় পত্রালী করে থাকে। তাছাড়া প্রতিদিন এদেরকে নিয়ে জাতীয় টিভি চ্যানেলে সংবাদ বা পত্রিকার বিভিন্ন পাতায় অভিন্ন শিরোনাম হয়। “শিশুরা পথে জন্মায় না, সমাজ তাদের কে পথশিশু হিসাবে তৈরী করে। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হলে- “পথশিশু বলে কিছু নেই। সমাজ তাদেরকে পথশিশু বানায়। দারীদ্রতা, মা- বাবার অসচেতনতা বা বিবাহ বিচ্ছেদ, কিংবা অর্থলোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর কারণে পথশিশুদের আবির্ভাব। ইসলামে শিশুদের নিয়ে সূরাও আছে। বিশেষত এ সকল ছিন্নমূল, ইয়াতীম, মিছকীন শিশুদের জন্য সমাজ ও পরিবারের প্রতি মহান আল্লাহর কঠিন নির্দেশ  রয়েছে সূরা মাউনে।

অথচ ইসলামসহ বিভিন্ন আইনের তোয়াক্কা না করে উল্টো বুড়ো আঙ্গুল প্রদর্শন করছে প্রদর্শকরা। প্রতিদিন পথশিশু প্রদর্নশনী চলছে। কারো মাথা ব্যথা নেই। কিন্ত  আমরাই এদেরকে রাস্তার মানুষ বানিয়ে দেই। এতে আমাদেরই অনেক সুবিধা, অল্প টাকায় অনেক সময় ওদেরকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেই। আবার ওরাই সারাদিন মানুষের কাছে হাত পেতে থাকে আর সবাই সাধ্যানুযায়ী দিয়ে থাকে। এই সামান্য দেয়াটাই ওদের অনেক ক্ষতির কারণ। ওদের কে আমরা লোভী বানিয়ে দেই। হাত পাতলেই যখন টাকা পাওয়া যায়, তাহলে রাস্তায়ই ভালো। শিশুদের নিয়ে কাজী নজরুল গেয়েছেন “আমরা নতুন আমরা কুড়ি, নিখিল মানব বন্দরে, লক্ষ আশা অন্তরে,”।

শিশুরা গাইছে “আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয় একদিন, ওহো বুকের গভীরে, আছে প্রত্যয়, আমরা করবো জয় নিশ্চয়।” তারপরও বলি, আসলে দারীদ্রতা শিশুদের পথে নিয়ে আসে। যেনো ওরা গাইছে সেই গান, “এই পথ যদি শেষ না হয়, তবে কেমন হবে ওগো বলতো।” কিন্তু ওরা গাইছে- “আমরা শিশু, আমাদেরও আছে অধিকার।” কে শুনবে তাদের সব হারানোর আর্তনাদ। কে শুনবে তাদের প্রয়োজনের কাকুতি। হৃদয় নিংড়ে কোনো কথা বলতে গেলেই নেমে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার।

“একটা জরীপে দেখা গেছে, পথ শিশুদের ৬৩ শতাংশ শিশুই ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী। আর সারা দেশে ৮৩ শতাংশ শিশুরাই নিজেদের খাবার নিজেরাই সংগ্রহ করে থাকে। তাদের ৬৫ শতাংশ শিশু মাদকাসক্ত ও ৮০ শতাংশ শিশু যথাযত টয়লেট ব্যবস্থা নেয় না। এরপরও তাদের পুনর্বাসন, মোটিভেশন কিচ্ছু হয়না। ” নাম মাত্র, লোক দেখানো কিছু উদ্যোগ প্রত্যাশিত হলেও আয়োজন দেখলে পথশিশুদের জন্য তা উপহাসই মনে হয়।

জাতিসংঘের শিশুসনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন আছে। এ আইনে উল্লেখ রয়েছে, “শিশুর বেঁচে থাকা তাদের জন্মগত অধিকার। এরই সাথে শিশুর জন্য তার অধিকারের কথাও মনে রাখতে হবে সচেতন সমাজ ও আপামর জনতার। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে ১৫ বছরের কমবয়সী সকলকে শিশু বলা হয়েছে।

আমরা সব সময় সমস্যার সামনের দিকটাই দেখি এবং এ নিয়ে কাজও করি। যেমন  এদের নিয়ে স্কুল খোলি, সভা-সেমিনার করি, লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেই, কিন্তু সমস্যার গভীরে যাইনা বা এ নিয়ে জানতেও চাই না।
প্রথমে আমাদের জানতে হবে এই পথশিশুদের আর্বিভাব হচ্ছে কি ভাবে। কেন দিন দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমারও অনেক দিনের আগ্রহ এ বিষয় জানার। একদিন সুবর্ণ মওকাও পেয়ে গেলাম।

রিক্সায় চড়ে যাচ্ছি। আমি একা চুপ করে বসে থাকতে পারি না। রিক্সাওয়ালাকে জিঙ্গেস করলাম- বিয়ে করেছেন?
-হ মামা, আলহামদুলিল্লাহ। তিনটা কইরালছি মামা।
-ছেলে মেয়ে ?
-ঐ দুইডা পুলা আর পাচ খান মাইয়া মামা। কে… মামা!
-না এমনি। তা সবাই কি একসাথে থাকে?
-না মামা, তিন জায়গায় তিনটা বিয়া কইরালছি মামা।
-অবাক হলাম। রিকশাওয়ালা বলতে লাগলো…।
দেশের বাড়িতে মামা মায়ে বাপে মিইল্লা দিছে এক্কান, রুটিরুজির জন্য গেছিলাম চট্টগ্রাম শহরে, ব্যাক দিন যাওয়ার পর সেইখানে কইরালছি আরেক্কান বিয়া। কিছুদিন না যাইতেই বৌ আর পোলা মাইয়াগো জ্বালায় আয়া পড়ছি পলাইয়া। এহানে আছি তিন বছর ধইরা। কি করুম, ভালো চান্স পায়া এহানে ও একটা কইরালছি। ওহনে পোলায় আছে।
-সব মিলে আপনার কয়টা সন্তান?
-জানামতে ত্ব মামা আট্টা। আর কথা হলো না। আমিও আমার গন্তব্যে পৌছে গেলাম।
জানেন এই আট্টা শিশুই পথশিশুতে রুপান্তরিত হয়। আর অধিকাংশই এরা বেড়ে উঠে শিক্ষা, মায়া, মমতা এবং ভালোবাসার গভীর বন্ধন ছাড়া।
তা এদের অপরাধ বা সন্ত্রাসি হতেও তেমন একটা সময় লাগে না।
আমাদের এখন উচিত এই সকল মানুষদের বুঝানো। আপনার একার জন্য আজ কতটি জীবন বিপন্ন। এই শিশুগুলো আজ রাস্তার শিশু বা পথশিশু হিসাবে পরিচিত।
আমার মতে যদি সচেতনরা একটু গভীরে গিয়ে অসচেতন, অর্ধ শিক্ষিত, বহুবিবাহ কারী মানুষগুলোদের বুঝাতে পারি, তাহলে এই সমস্যা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। একা নয়; সবাইকে নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচার নামই জীবন।

শেষ করবো শিল্পী সায়ানের একটি গানের অন্তরা দিয়ে।
” আমি তাজ্জব বনে যাই,
দেখি মানুষের ঘর নাই।
মানুষের ঘরে বাস করে ছোট্ট সে চড়াই”

লেখক : শিক্ষার্থী- বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ ও সহসাধারণ সম্পাদক গোলাবশাহ্ কিশোর সংঘ।