আহমেদ ফয়সাল । ২৭ মার্চ ২০১৭।

শহীদ জামালের স্বীকৃতি আদায় করতে অনেক দপ্তর ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দিয়েছি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আমার বাবা শহীদ জামালের স্বীকৃতি মেলেনি। আমিও পাইনি শহীদ সন্তানের স্বীকৃতি। বুকভরা বেদনা নিয়ে এ কথাগুলো বললেন ১৯৭১-এ বিয়ানীবাজারের মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জামালের মেয়ে স্বাধীন সুন্দরী।

স্বাধীন সুন্দরী জানান, ১৯৭১ সালের ১৩ জুলাই রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে খুঁজতে গ্রামে অভিযান চালায়। সেনা অভিযান থেকে বাঁচতে বাবা নানাশ্বশুড়ের বাড়ি বৈরাগীর জয়নগর উছাবাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৪ জুলাই ভোরে ভারত চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বাবা। বাড়ি থেকে আমার মা ও দাদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। খাসা দীঘিরপাড় এলাকায় যাওয়ার পর রাজাকার ফুরকান মাস্টার এক চৌকিদারের সহযোগিতায় বাবাকে আটক করে খাসা মসজিদে আটকে রাখে। সেখান থেকে খাসা দীঘিরপাড়ে রাজাকার আবদুল খালিকের বাড়ির সামনে নিয়ে যাওয়া হয় বাবাকে। স্বাধীন সুন্দরী চোখের পানি মুছে আরও বলেন, আমার দাদি বাবার আটকের খবর শুনে সেখানে ছুটে যান। বাবাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন চালাচ্ছে রাজাকার ফুরকান মাস্টার_ এ দৃশ্য দেখে তার দুই পা জড়িয়ে বাবার প্রাণভিক্ষা চান দাদি। ফুরকান মাস্টার দাদিকে লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও বাবাকে ছাড়াতে পারেননি দাদি। ফুরকান মাস্টার অন্য রাজাকারদের সহযোগিতায় বাবা ও ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামের মনোহর আলীকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সেখানে রাতভর নির্যাতন চলে বাবার ওপর।

পরদিন ১৫ জুলাই বাবাকে বিয়ানীবাজার থানার পেছনে কাঁঠালতলায় নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। মারার আগে পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার বাবার শেষ ইচ্ছা কী জানতে চাইলে দাদিকে দেখার ইচ্ছার কথা জানান। থানার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাবা দাদিকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলেন।

স্বাধীন সুন্দরী জানান, বাবার শহীদ হওয়ার স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেননি আমার দাদি আয়েশা বেগম ও মা নেহারুন নেছা।

স্বাধীন সুন্দরী আরও বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩১ ডিসেম্বর আমার জন্ম হওয়ার সংবাদ শুনে শহীদ জামালের সহকর্মী মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে ছুটে আসেন। তারা আমাকে কোলে নিয়ে আদর করেন। এসব মুক্তিযোদ্ধা আমার নাম রাখেন স্বাধীন সুন্দরী। জন্মের ১২ দিনের মাথায় আমার নানা মায়ের সঙ্গে আমাকেও নানাবাড়ি নিয়ে যান। মামা ছরাব আলী আমাকে ভরনপোষণ ও লেখাপড়া করান। রাজাকারদের ভয়ে মামা আমার নাম পরিবর্তন করে সুন্দরী বেগম নামে স্কুলে ভর্তি করেন- আমার দাদি আমাকে এসব বলেন।

স্থানীয়ভাবে শহীদ জামাল স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ জামাল স্মৃতি সংসদ গড়ে উঠলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনসহ সব জায়গায় শহীদ পিতার স্বীকৃতি পেতে আবেদন করলেও তা পাননি স্বাধীন সুন্দরী। ব্যক্তিগত জীবনে দুই কন্যাসন্তানের জননী স্বাধীন সুন্দরীর একটাই কামনা, মরার আগে শহীদ পিতার স্বীকৃতি চান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবার স্বীকৃতি চান কন্যা স্বাধীন সুন্দরী। তিনি বলেন, বাবাকে কারা ধরে নিয়ে হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে, পাক সেনার হাতে তুলে তাদেরও বিচার চাই।