প্রয়াত কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী কিশোর কুমারের বিখ্যাত একটি গানরে প্রথম অন্তরায়ের কয়েকটি লাইন ‘যে কথা যায় না বলা শুধু বোঝা যায়/মনের গভীরে- সেতো আলো হয়ে রযে যায়’। বর্তমান সময়ের তরুণদের কাছে এ গানটি হয়ত-বা কোন মূল্য রাখে না। আমাদের সময়ে গানটির একটি বিশেষ অংশ ‘মনের গভিরে সে তো আলো হয়ে রয়ে যায়’ শুনে আমরা পুলকিত হতাম। কিন্তু এখন এ লাইনটি শুনলে এক ধরনের বিষাদময়তা, হতাশা, দূরাশা, শূন্যতা এসে ভীড় করে। কেন? নিজে নিজেকে প্রশ্ন করি। উত্তর পাই না। যখন ছাত্র ছিলাম খুব কাছ থেকে ছাত্র রাজনীতি দেখেছি। দেখেছি রাজনীতির নামে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নির্মম প্রচেষ্টা। হকি স্টিকের আঘাতে খুব কাছ থেকে বন্ধু সঞ্জয়ের মৃত্যুও দেখেছি। দূর থেকে হাহাকার করা ছাড়া কিছুই করতে পারি নি।

ছাত্র রাজনীতির আরেক নির্মম শিকার বিয়ানীবাজারের এক তরুণ। আধিপত্য বিস্তার, নিজেদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি কিংবা নিজের কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র যে কারনে হোক না কেন প্রাণ কিন্তু দিতে হলো তাকে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী খুজে বের করবে প্রকৃত রহস্য। আমরা খুঁজবো অন্য বিষয়।

মৃত্যুর পর অভিভাবকের দাবি তাঁর সন্তান রাজনীতি করত না। প্রতিষ্ঠান প্রধানের দাবি সে অত্র প্রতিষ্ঠানের ছাত্র নয়। রাজনৈতিক সংগঠনের দাবি সে তাদের কর্মী নয়। তাহলে সে কে? সে কি ভিন গ্রহ থেকে আগত কোন অচিন প্রাণী! যখন জীবিত ছিল তখন অনেক পরিচয় ছিল তার। যেই প্রাণ হীন হয়ে গেল তখন সে হয়ে গেল বড়ই অপ্রয়োজনীয়।

ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে দেখা যায় এ দেশের তরুণ, যুবকরা ভাষার দাবিতে, স্বাধিকার আদায়ে, মুক্তিযুদ্ধে এমন কি গণতন্ত্রের দাবিতে রাজ পথে প্রকাশ্যে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে। সে সব গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধ এই পাললিক ভূমিতে কেন এভাবে প্রাণ যাবে? এ ভাবে প্রাণ হরণের দায়িত্ব কি আমাদের উপর বর্তায় না? মৌখিক সাক্ষাতকার কিংবা লিখিত বক্তব্য দিয়ে এ দায় কি এড়ানো যায়!

অন্যদের কাছে এ প্রশ্নের কোন জবাব আছে জানি না। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর হলো একটা বিশাল ‘না’। যে ‘না’র পরিধি ৫৬ হাজার বর্গমাইল।

পৃৃথিবীতে কেউ অপরাধী বা সন্ত্রাসী হয়ে জন্মে না। তার পারিপাশির্^ক পরিবেশ, লোভ, ক্ষমতাবান হওয়ার মিথ্যা কুহেলিকা তাকে ভুল পথে যাবার মদদ প্রদান করে। অবাস্তব ভবিষ্যতকে এতো মুখরোচকভাবে তার সামনে উপস্থাপন করা হয়- যে সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্য ধরার ক্ষমতায় লোভ পায়। প্রতারণা কিংবা প্ররোচনা যাই হোক না কেন কারো না কারো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্দনে এ দেশের কিছু তরুণ, যুবক আত্ম হননের এ পথ বেছে নিচ্ছে। এভাবে প্রতারিত করার দায়িত্ব কি আমাদের উপর বর্তায়?

শুরুতে যে গানটি দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম সে গানটি হুবহু শেষ করতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করেছে দুটি শব্দ পরিবর্তন করে -যে কথা যায় না বলা শুধু বোঝা যায়/ মনের গভীরে সেতো নীরব ক্ষত হয়ে রযে যায়’ এভাবে গাইতে। জানি না এ ভাবে শেষ হওয়াকে নিয়তি বলে কি না। তাই যদি হয় তাহলে আমরা কি নিয়তির হাতে বন্দি। না এই নিয়তি কোন অদৃশ্য শিকলে আটকে আছে।

লেখক- শিক্ষক  ও  সংস্কৃতি কর্মী।