সিলেট বিভাগের প্রচলিত অনেক প্রথার মধ্যে মেয়ের বাবার গলার কাটা হয়ে আজও ঝুলে আছে ইফতারের প্রথা। রমজান আসলেই তার ২-৩ মাস আগে থেকে চিন্তা করতে হয়- কি করে মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানোর টাকা জোগার করতে হবে। অনেক বাবা ইফতারের এই আয়োজনের জন্য নিজের গরু ছাগল এমনকি হাস মোরগও বিক্রি করেন। সুদে টাকা এনে তা মেটাতে বছর পার করেছেন অনেকেই।

সিলেটে ইফতার প্রথা পুরাতন এক ঐতিহ্য। বাবার বাড়িতে থেকে রমজানে মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানো হয় । সে ইফতার শুধু মেয়ের বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা। ছেলের শ্বশুড়বাড়ি থেকে যেদিন ইফতার আসবে সেদিন বন্ধুবান্ধ আর আত্মীস্বজনকে দাওয়াত দেওয়া হয়। সেই সাথে একটি নিরব প্রতিযোগিতা চলে- কার শ্বশুরবাড়ি থেকে কত বেশী আইটেমের ইফতার এলো, কে তার শ্বশুরবাড়ির ইফতার কয়শত মানুষকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াল।

যার শ্বশুরবাড়ী থেকে যত বেশী ইফতার আসে তার তত সুনাম। তেমনি যে মেয়ের বাবার সে সক্ষমতা কম, তিনি ইফতারি দিয়ে খুশি করতে না পারলে- অনেক ক্ষেত্রে কথা শুনতে হয়। এই বছর করোনা সংকটের কারণে প্রথম দিকে এই ইফতার পাঠানো থেকে নিস্তার মিললেও। দোকানপাঠ খোলায় অনেকেই ইফতারের পাঠিয়েছেন। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এবং করোনা সংক্রমণের ভয় থাকায় তা খুবই নগণ্য। করোনা এক্ষেত্রে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই প্রথার অবসান চায় নতুন প্রজন্ম। নতুন প্রজন্ম একে জুলুম হিসেবে দেখছে। এই ইফতার নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। বাবার বাড়ি থেকে মনমত ইফতার না আসলে শ্বশুড় বাড়ির মানুষের থেকে নানা কটু কথা শুনতে হয়। হয়তো মেয়ে জানে তার বাবার আর্থিক অবস্থা। হয়তো ইফতার দেওয়ার মত সামর্থ্য তার বাবার নেই। কিন্তু নিজের বাবার সম্মানের কথা ভেবে, শ্বশুর বাড়িতে নিজের সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে অনেক সময় ভেতরে চাপা কষ্ট নিয়ে মেয়েও বাবাকে অনুরোধ করে। মেয়ের আবদার ফেলতে পারেন না বাবা। যেভাবেই হোক টাকা সংগ্রহ করেন। গত বছরের রমজানের চার মাস আগে শামীম আহমদের সঙ্গে হেলেনা বেগমের (২০) বিয়ে হয় । বিয়ের পর প্রথম রমজান মাসে সিলেটের ঐতিহ্য হিসেবে (১০ মে ২০১৯) সিলেটের জৈন্তাপুরের ঘিলাতৈল গ্রামে বধু হেলেনার বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে ইফতারি পাঠানো হয়। কিন্তু সেই ইফতার সামগ্রী শশুড়বাড়ির লোকজনের মনমত হয়নি। সেই ইফতারি নিয়ে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের গালমন্দ শুনতে হয় হেলেনাকে। এরই জেরে নিজ ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন হেলেনা।

এতো একজন হেলেনার গল্প। কিন্তু এভাবে কতশত হেলেনাকে দিনের দিনের পর দিন অপমান আর সামাজিক মানসম্মানের ভয়ে নিরবে কাঁদতে হয়। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার তারিক আহমেদ গত বছর রমজানের ১ মাস আগে ৮ লক্ষ টাকা খরচ করে একমাত্র বোনের বিয়ে দেন। একমাত্র বোন তাই ধুমধামে বিয়ে দিতে গিয়ে ৫ লাখ টাকা ঋণ করে ফেলেন। বিয়ের একমাস পর ঋণের চাপের মধ্যেই আসে রমজান। তাই সিলেট ঐতিহ্য মেনে বোনের বাড়ি ইফতার সামগ্রী পাঠাতে হবে। কিন্তু হাতে একটাকাও নেই। আগের ঋণ রয়ে গেছে, তাই নতুন করে টাকা ধার দিচ্ছেনা কেউ। এদিকে ইফতার না পাঠালে বোনকে কথা শুনতে হবে, পাড়া প্রতিবেশীর কাছে বোনের ইচ্ছত সম্মান থাকবেনা, লোক লজ্জার ভয় তার উপর ঐতিহ্য। তাই বাধ্য হয়ে হালের শেষ গরুটি বিক্রি করেন ৭০ হাজার টাকা । সেই টাকা দিয়ে ইফতার সামগ্রী নিয়ে যান। বোনের বাড়িতে প্রচুর মানুষ দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। যার কারণে ৭০ হাজার টাকার ইফতারে সবার হয়নি। কেউ কিছু না বললেও লজ্জা পান মনে মনে।

বোন জামাই বলেন, ভাইয়া আমাদের বন্ধু-বান্ধক আত্মীয় স্বজন বেশীতো তাই। আগামী বছর একটু চেষ্টা করবেন । সবার জন্য এই প্রথা থাকলেও অর্থনৈতিক ভাবে সবার অবস্থা এক না থাকায় হাজার হাজার মেয়ের বাবাকে রোজার মাসে মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠাতে গিয়ে যেতে হয়ে মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারের ভিতর দিয়ে। নিম্ব আয়ের মানুষদের মধ্যে এ এক ভীতিকর সামাজিক নিয়ম।

তবে এই প্রথা বিরুদ্ধে বর্তমান প্রজন্ম সোচ্চার, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আব্দুল কাইয়ুম জানান, এই প্রথায় একজনের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমার চোখের সামনে অনেকে সুদে টাকা এনে, কেউ নিজের জমি বিক্রি করেও ইফতারি পাঠান। আমি বিয়ে করেছি ৭ বছর, কিন্তু আজ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি থেকে ইফতারী নেইনি।

সংস্কৃতিকর্মী আ.স.ম ছালেহ সোহেল বলেন, এ বছর করোনার কারণে অনেকেই রেহাই পেয়েছেন, কিন্তু এটা সমাধান নয়। সমাধান হচ্ছে এই প্রথার বিরুদ্ধে আমাদেরকে সামাজিক আন্দোলন করে জনমত গঠন করতে হবে। যে প্রথা মানুষকে চাপে রাখে সেটা কু-প্রথা।

এ বিষয়ে সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ সুয়েল আহমদ বলেন, এই প্রথা থেকে বর্তমান সময়ে অনেকেই বের হয়ে আসছেন। রমজান মাসে মেয়ের বাড়িতে ইফতার দেয়াটা অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের জন্য মেয়ের মুখ বড় করতে যেয়ে বিত্তের প্রদর্শনীতে পরিণত করা হয়েছে। আবার দরিদ্র মা-বাবার এই প্রথা পালন করতে গিয়ে ঋণগ্রস্থ হতে হয়। তাই মেয়ের বাড়িতে ইফতার নয়, বরং মেয়ের নিজের হাতে রান্না করা খাবার বুড়ো মা-বাপের জন্য পাঠনোর সংস্কৃতি শুরু করা উচিত।

এমন প্রথা ইসলামে নেই জানিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের মহা-পরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল জানান, ইসলামে এমন কোন বিধান নেই, সংযমের মাসে কারো ওপর জোর করে ইফতারের আয়োজন চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় হবে। যার যা সামর্থ আছে তা দিয়েই ইফতার করবে।

‘এবি টিভি’র সর্বশেষ প্রতিবেদন-