শুরুর দিকে মানুষ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে চলেছিল। মানুষ প্রকৃতির বৈরী আচরণ সম্মিলিত ভাবে মোকাবেলা করত। সময়ের সাথে সাথে সভ্যতার উৎকর্ষতার কল্যানে প্রকৃতিকে বশে আনতে আরম্ভ করলো মানুষ। সফলতাও আসতে লাগল রাতারাতি। তবে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হবার বিষয় নয়। প্রকৃতির নিজস্ব একটা ব্যবস্থা রয়েছে। এই ব্যবস্থায় আঘাত আসলে প্রকৃতি উল্টাপাল্টা আচরণ করে।

বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারির যে ত্রাস পৃথিবীরবাসী সাফারিং করছে, তা যে প্রকৃতিকে মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের ফল—এতে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।

প্রায় ৫১ কোটি ১০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীতে প্রায় সাত কোটি জনগণ, অসংখ্য জীব-জন্তু ও উদ্ভিদরাজির জন্য দুনিয়াটা বসবাসের অনুপযুক্ত হতে যাচ্ছিল। জলবায়ুর পরিবর্তন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, অসময়ে বৃষ্টি, শীতের প্রকোপহীন পৌষ-মাঘ সহ নানা অসংগতি আমরা অবলোকন করছিলাম। এমনই একটা সময়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষে চীন দেশের উহান শহর থেকে খবর ছড়িয়ে পড়লো এক অজানা রোগে জ্বর-সর্দি-কাশি নিয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে।

পরে জানা গেল এ রোগের নাম কোভিড-১৯। চীন থেকে পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল এই মহামারি। চীন উহান শহরে কাউকে ডুকতে এবং এখান হতে কাউকে বাহির হতে নিষেধ করল। এ পথে হাটল অন্যান্য দেশগুলো। যার নাম লকডাউন।
অপরিচিত শব্দ কুয়ারেন্টাইন, হোম কুয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন শব্দগুলো খুব দ্রুত মানুষের মুখেমুখে ঘুরতে লাগল।
ডব্লিউ বেরি (১৯৭২) মানুষ কিভাবে এই গ্রহের ধ্বংস সাধন করছে তার ওপর আলোকপাত করেছেন। কথিত এই ধ্বংস প্রক্রিয়ার সাথে প্রধানত দুইটি সমস্যার সংশ্লিষ্ট দিকসমূহ বিবেচিত হয়ে আসছে, প্রথমটি সম্পদ নিঃশেষকরণ এবং দ্বিতীয়টি পরিবেশ দূষণ।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিল্পায়িত ও উন্নয়নের আত্ব-তাড়না শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশকে অনেকটা সুযোগ এনে দিয়েছে তৃতীয় বিশ্বের খনিজ ও অন্যান্য সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রনের। (চৌধুরী হাসানুজ্জামান, ২০০০:৩৮৮) পুঁজিবাদী আধুনিক প্রথমবিশ্বের জন্য তৃতীয় বিশ্বের খনিজ ও অন্যান্য সম্পদের প্রয়োজনীয়তা ও এর বেপরোয়া উত্তোলন পরিবেশকে করেছে রিক্ত।

পৃথিবীর উষ্ণতা মূলত দুটি কারণে বৃদ্ধি পেতে পারে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যজনিত কারণ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে পৃথিবীর অক্ষরেখার পরিবর্তন, সূর্যরশ্মির পরিবর্তন, মহাসাগরীয় পরিবর্তন ও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত মূলত দায়ী।

বিজ্ঞানীরা মূলত মনুষ্যজনিত কারণে উষ্ণতা বৃদ্ধিকারক গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ বৃদ্ধিকে বর্তমানকালের উষ্ণতা বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ গ্রীন হাউজ গ্যাস গুলোর মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড, জলীয়বাষ্প, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন অন্তর্ভুক্ত। এসব গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীর চারপাশে কম্বলের মত একটা আবরণ তৈরি করে, যা ভেদ করে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু বের হতে পারে না। এর ফলে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।

পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে বহুলাংশে দায়ী কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এর পরিমাণ প্রাক শিল্প যুগ সময়ের থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ১০০ ppmv বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মধ্যে বিগত ৩০ থেকে ৪০ বছরে প্রায় ৫০ ppmv বৃদ্ধি পেয়েছে। (কারেন্ট আ্যফিয়ার্স, জুন ২০১৪)

সভ্যতা বিকাশের জন্য আমরা বহুলাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি জীবাশ্ম জ্বালানির উপর, যা প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। আবার দ্রুতহারে বন ধ্বংস ও ভূমির বিন্যাসের পরিবর্তন কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ উদ্ভিদ কার্বন ডাই-অক্সাইডের সঞ্চয় ভান্ডার হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বন উজাড়করণের ফলে সেই কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলে মুক্ত অবস্থায় থাকে।

পরিবেশতাত্ত্বিক জেমস লাভলক ব্যক্ত করেন যে, ‘পৃথিবী আদপে ভঙ্গুর নয়, আমরা নিজেরাই ভঙ্গুর। আমরা ইতোমধ্যে যেসব বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছি বস্তুত তার চেয়ে ঢের বেশি মারাত্মক বিপর্যয় প্রকৃতি প্রতিরোধ করেছে। আমরা যাই করি না কেন তাতে প্রকৃতি ধ্বংস হবে না। কিন্তু আমরা খুব সহজে নিজেদেরকে নিজেরা ধ্বংস করতে পারি। এসব বৈজ্ঞানিকদের কোন প্রলয় কাহিনী নয় যে গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টি, বনাঞ্চল ধ্বংস এবং গ্রীন হাউজ প্রভাবের ভয়ানক পরিণতি সমূহ ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যেই আমাদের উপর এসে পড়বে। সেগুলি আসবে আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতাশূন্য বিশ্ময়রূপে এবং কিছু ক্ষেত্রে যেগুলি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভবত অতি ব্যয়বহুল কম্পিউটারের পক্ষেও সম্ভব হবে না।‘ (চৌধুরী হাসানুজ্জামান, ২০০০:৩৯১)

জেমস লাভলকের ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভবত পৃথিবীবাসী অবলোকন করছে। কেউ কি জানতো পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ নিঃস্তব্ধতার আবরণ ঢাকা পড়বে!

মহান আল্লাহ মানুষ ও অন্যান্য মাখলুকের জন্য বাস উপযোগী করে দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন। যার প্রমান কোরআন ও বিজ্ঞানের যৌক্তিক আলোচনায় দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠে। ‘(কোরআন) এটি তাঁহার কাছ হইতে অবতীর্ণ, যিনি ভূমন্ডল ও সমুচ্চ নভোমন্ডল সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি পরম দয়াবান, (বিশ্বলোকের) সিংহাসনে সমাসীন। নভোমন্ডলে, ভূমন্ডলে, এই দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে এবং ভূগর্ভে যাহা কিছু আছে তাহা তাঁহারই।’(সূরা তা’হা, আয়াতঃ ৪-৬)। ‘তোমরা কি লক্ষ্য কর নাই আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন সপ্ত স্তরে বিন্যস্ত আকাশমন্ডলী এবং সেথায় চন্দ্রকে স্থাপন করিয়াছেন আলোকরুপে ও সূর্যকে স্থাপন করিয়াছেন প্রদীপরুপে?’(সূরা নূহ, আয়াতঃ ৭১)। ‘আমি ভূপৃষ্ঠকে বিস্তৃত করিয়াছি এবং তাহার উপর পাহাড় গাড়িয়া দিয়াছি, তাহাতে সব প্রজাতির উদ্ভিদ সুপরিমিতভাবে উৎপাদন করিয়াছি।’(সূরা হিজর, আয়াতঃ ১৯)। ‘তিনিই পৃথিবীতে স্থাপন করিয়াছেন পর্বতমালা  যাহাতে ইহা তোমাদিগকে লইয়া এদিক ওদিক ঢলিয়া না পড়ে।’( সূরা লুকমান, আয়াতঃ ১০)।

অতি দক্ষ কারিগরের অপরুপ ও সুনিপুণ সৃষ্টিশীলতায় কোন খুঁত পাওয়া যাবেনা বলে দ্ব্যর্থহীন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন মহান আল্লাহ। ‘তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করিয়াছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিকর্মে কোনরূপ অসংগতি দেখিতে পাইবে না। আবার দৃষ্টি ফিরাও; কোথাও কোন দোষত্রুটি দৃষ্টিগোচর হয় কি? অতঃপর তুমি বারবার তাকিয়ে দেখো— তোমার দৃষ্টি ক্লান্ত, শ্রান্ত ও ব্যর্থ হইয়া তোমার দিকে ফিরিয়া আসিবে।’ (সূরা মূলক, আয়াতঃ ৩-৪)

(চলবে…)

লেখক- প্রভাষক, আছিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ।

‘এবি টিভি’র সর্বশেষ প্রতিবেদন-