কালের পরিক্রমায় বর্ষপঞ্জিতে আবার ঘুরে এলো ভয়াবহ ট্র্যাজেডির ১৪ জুন। আর সেই সাথে যোগ হলো মাগুরছড়া বিপর্যয়ের আরও একটি বছর। আজ বুধবার মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ২০ বছর পূর্তি। তবে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ও টালবাহানা করে চুক্তি মোতাবেক মার্কিন কোম্পানিটি ক্ষতিপূরণ দেয়নি আজও।

১৯৯৭ সালের ১৪ জুন দিবাগত রাতে মৌলভীবাজারের মাগুরছড়া গ্যাস ক্ষেত্রে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি অক্সিডেন্টালের দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও ত্রুটির কারণে ব্লো-আউট হয়। ঘটনার পরপরই ১৪ জুন মাগুরছড়া দিবস তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ওই বছরের ৩০ জুলাই প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ওই গ্যাস ক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাস ধ্বংস হয়। বন ও পরিবেশের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। পানি সম্পদেরও বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়। দুই বলিউমে ৫০০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টে বিস্তৃত ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ রয়েছে। মাগুরছড়া গ্যাসকূপে সেদিন বিস্ফোরণে মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা চারিদিকে ছড়িয়ে নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় এশিয়ার একমাত্র রেইন ফরেস্ট লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গাছপালা, জীবজন্তুসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা।

বিষ্ফোরণে প্রত্যক্ষভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বন ও পরিবেশের জীববৈচিত্র্য, আখাউড়া-সিলেট রেলপথ, ফুলবাড়ি চা বাগান, কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল প্রধান সড়ক, মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাড়িঘর, পানজুম এলাকা ও পিডিবি’র ৩৩ হাজার কেভি প্রধান বিদ্যুত লাইন। এছাড়া পরোক্ষভাবে ২৮টি চা বাগানের ক্ষতিও সাধিত হয়েছিল। দীর্ঘ ৬ মাস বন্ধ ছিল কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক ও আখাউড়া-সিলেট রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কি.মি. (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতাপ বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয়। কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০টি চা বাগানে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বিদ্যুত সংকট দেখা দেয়। ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের বৃক্ষসম্পদ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি ডলার। দুর্ঘটনার দু’ বছরের মধ্যে ফুলবাড়ি চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের ক্ষতিগ্রস্ত টি প্লান্টেশন এলাকার জন্য কিছু ক্ষতিপূরণ   পেয়েছিল।
এ অগ্নিকা-ের ১৮ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও আজও মার্কিন কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি কেউ। গত ১৭ বছর ধরে দেশে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা সরকার ক্ষতিপূরণ আদায়ে এগিয়ে আসেনি। তবে পিছু হটেনি পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তারা ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আজও প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন অব্যাহত রাখে। গত বছরের ১৪ জুন কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

ভয়াবহ আগুনে পোড়া সেই জায়গায় এখন সবুজের সমাহার। এ সবুজের মধ্যেই মূল কূপস্থলটি এখনও পুকুরের মতো আকৃতি ধারণ করে টিকে আছে। চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করা হয়েছে। টিলার ওপর সবুজ বনায়নের ফাঁকে ফাঁকে আগুনে পোড়া, মাথাভাঙ্গা ও ডালপালাবিহীন কালো রঙের গাছগুলো দুর্ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি বছর জুন মাস এলে বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় হয়। কিন্তু আজও ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি। স্থানীয়রা জানান, মার্কিন কোম্পানির অদক্ষতা ও অদূরদর্শীতার কারণে মাগুরছড়া বিস্ফোরণে মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা চারিদিকে ছড়িয়ে নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের হাজার হাজার গাছ পালা, জীবজন্তু, বাড়িঘরসহ আশপাশের এলাকা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা, সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিবেন। এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, অক্সিডেন্টাল-ইউনোকলের বর্তমান উত্তরসূরী শেভরনকে নোটিশ দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে গেলে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সহসা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টি আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে এবং শেভরনের কর্মকা- আজও চলমান। যার ফলে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টি আজও অমীমাংসিত।

আন্দোলনকারীরা জানান, বিগত ১৭ বছর ধরে ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে লংমার্চ, মানববন্ধন, পদযাত্রা, গণসংযোগসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু আজ অবধি ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়নি। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিডেন্টাল ও ডয়টেক কোম্পানি বে¬া-আউটে ক্ষতিগ্রস্ত রিগসহ সংশ্লি¬ষ্ট অন্যান্য যাবতীয় যন্ত্রপাতির ক্ষতি বাবদ প্রায় ৩ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ বীমা কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। তারা অর্থাৎ অক্সি তদন্ত রিপোর্ট ব্যবহার করে ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিলেও আমাদের দেশের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পারার বিষয়টি বোধগম্য নয়। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় পরিবেশবাদী নেতা মুজিবুর রহমান রঞ্জু জানান, মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের চরম খামখেয়ালিপনার কারণে সেদিনের ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণে চা বাগান, বনাঞ্চল, বিদ্যুত লাইন, রেলপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভূমিস্থ পানি সম্পদ, রাস্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জ্বলে ছাই হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ। মারা যায় হাজার হাজার বন্যপ্রাণী। তিনি আরও জানান, মাগুরছড়ায় গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পর সরকারের গঠিত সর্বশেষ তদন্ত কমিটি শুধু গ্যাসের ক্ষতি বাবদ ৬০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছিল। এছাড়া তেল-গ্যাস বন্দর রক্ষা কমিটি ও বিশেষজ্ঞমহল বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী গ্যাস ও পরিবেশগত ক্ষতি বাবদ ১৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করেন। এ ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও মেলেনি।

পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান জি ডি সন সুচিয়াং জানান, মাগুরছড়া গ্যাস ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় তাদের পুঞ্জির ৪০টি বাড়ির আংশিক ক্ষতি ও ৬টি ঘর সম্পূর্ণরূপে পুড়ে যায়। পানজুম এলাকার ৫০ একর জায়গা ভস্মিভূত হয়েছিল। পুঞ্জির ব্যবসা বন্ধ ছিল দীর্ঘ ৬ মাস। বিগত ২৫ বছরে তৈরি হওয়া পুঞ্জির ক্ষয়ক্ষতি বাবদ তারা ২ কোটি ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে ইউনোকল কোম্পানী মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জিকে ক্ষতিপূরণ বাবদ মাত্র ২৫ লাখ টাকা দিয়েছে বলে খাসিয়া হেডম্যান জানান।

অন্যদিকে দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কধারে সামাজিক বনায়নের রোপিত গাছের জন্য ৩ ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা, কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে ক্ষতিপূরণ বাবদ বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা দেয়া হয়। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির দেয়া এক রিপোর্টে জানা গেছে, লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা গ্যাসের আগুনে ক্ষতি হয়। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০ দশমিক ৫০ একর এলাকা। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ২০ একরে ৪.৭৫ ঘনফুট গাছ-গাছালির, ৫৫ হাজার ২০০ টি পূর্ণবয়স্ক বাঁশ এবং ১ লাখ ১৫ হাজার অপ্রাপ্ত বয়স্ক গাছ পুড়ে যায়। সবমিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২৬ একরের বড় আকৃতির প্রচুর মূল্যবান বৃক্ষ সম্পূর্ণ ও আংশিক পুড়ে যায়। একইভাবে ৪১.৫০ একরের ২২.৮২৫ ঘনফুট গাছ-গাছালিরও আংশিক ক্ষতি সাধিত হয়। সব মিলিয়ে পুড়ে যাওয়া গ্যাস, ক্ষতিগ্রস্ত বন ও পরিবেশের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি আদায়ে মার্কিন কোম্পানীসমূহের টালবাহানায় মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের বিগত ১৭ বছরে ৩ টি কোম্পানীর হাতবদল হয়েছে। কিন্তু পুুরো ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোনো পদক্ষেপ গৃহিত হয়নি।

দুর্ঘটনার ১৮বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ ক্ষতিপূরণ পায়নি সিলেট-আখাউড়া রেল  সেকশন, ক্ষতিগ্রস্ত বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। বনবিভাগের হিসাবমতে, প্রত্যক্ষ ক্ষতি ৩২ দশমিক ৫৩  কোটি এবং অন্যান্য ক্ষতি মিলিয়ে মোট ১৭৬ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা। এই সময়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় পুরো হিসাব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০৯ কোটি টাকা নিরুপণ করে মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টালের কাছে দাবি জানায়।

দুর্ঘটনার সময়ে তৎকালীন সরকারের খনিজ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার পর কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট  পেশও করেছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী, অক্সিডেন্টালের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়। ১৯৯৯ সালের আগস্টে অক্সিডেন্টাল কোম্পানী মাগুরছড়া গ্যাসকূপসহ তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় মার্কিনের অন্য কোম্পানী ইউনোকলের কাছে হস্তান্তর করে। ইউনোকল দায়িত্ব গ্রহণের পর ক্ষতিপূরণ বিষয়ে টালবাহানা শুরু হয়। কিন্তু গ্যাস উত্তোলনে ইউনিকল মাগুরছড়া পরিত্যক্ত কূপ এলাকার প্রায় ৩০০ গজ পশ্চিমে নতুন করে একটি ও জেরিন চা বাগানের অভ্যন্তরে একটি কূপ খনন শেষে গ্যাস উত্তোলন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে কালাছড়া গ্যাসকূপের সঙ্গে সংযুক্ত করে জাতীয় গ্যাস গ্রিডলাইনে অব্যাহতহারে অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ করছে। বর্তমানে শেভরণ স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, সামাজিক কাজে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে এলাকার মানুষকে খুশি করার প্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে!

পরিবেশবাদী সৈয়দ আবু জাফর জানান, ওই বিস্ফোরণে পুড়ে যায় ভূগর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাস। যার মূল্য প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। অক্সিডেন্টাল যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে ইউনিকল নামে আরও একটি কোম্পানির কাছে ফিল্ড বিক্রি করে বাংলাদেশ থেকে চলে যায়। পরবর্তীতে ইউনিকল ও শেভরন নামের একটি মার্কিন কোম্পানির হাতে গ্যাস কূপগুলো বিক্রি করে এ দেশ থেকে কেটে পড়ে। শেভরন নতুন কূপ খননের জন্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অনুসন্ধান চালিয়ে বন তথা এলাকার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। দেশের সম্পদ বিনষ্টকারী মার্কিন কোম্পানি শেভরনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বর্তমান সরকার আদায় করে নেবে-এমনটাই প্রত্যাশা করছেন পরিবেশবাদী ও সচেতনমহল।