প্রচলিত আছে, সিলেট-১ আসনে যে পাস করবে সে দল সরকার গঠন করবে। পরিসংখ্যান এমন ধারণাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে।

১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে সিলেট বিভাগের ১৯ আসনের মধ্যে বিএনপির হয়ে খন্দকার আব্দুল মালিক শুধু সিলেট-১ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওই সময় বিএনপিই সরকার গঠন করে। সম্ভবত এসব কারণেই সিলেট থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করাকে প্রায় সব বড় দলই রীতি হিসেবে নিয়েছে।

যথারীতি এবারও সিলেটে মাজার জিয়ারত করে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদসহ কয়েকটি দল। বিএনপি প্রচারণা শুরু না করলেও কারাগারে যাবার আগে বেগম খালেদা জিয়া সদলবলে এসে মাজার জিয়ারত করে গেছেন।

প্রধান তিন দলের শীর্ষ নেতার সিলেট সফরের পর থেকে অনেকটা আগেভাগেই সিলেটে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। মনোনয়ন পেতে দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। মাঠেও নিজের অবস্থান জানান দিতে সচেষ্ট তারা।

বিজয়ী প্রার্থী দলের সরকার গঠন ছাড়াও আরও একটি মিথ আছে সিলেট-১ আসনকে ঘিরে। এই আসন থেকে সাবেক আমলারাই নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ব্যতিক্রম কেবল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী ও বিএনপি নেতা খন্দকার আব্দুল মালিক।

এবার আমলা না রাজনীতিবিদ- কারা পাবেন দলীয় মনোনয়ন, এইনিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে রয়েছে জোর আলোচনা। মনোনয়ন পেতে তৎপর আছেন দুই পক্ষেরই একাধিক নেতা। নির্বাচন নিয়ে বিএনপি এখনো সিদ্ধান্তহীনতায়। দলীয় প্রধানের কারাবন্দিত্ব সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারণায়ও ভাটা ফেলেছে। ফলে খন্দকার আব্দুল মালিকের ছেলে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ছাড়া বিএনপির মনোনয়ন পেতে মাঠে আর তেমন কেউ সক্রিয় নন।

সিলেট-১ আসনের বর্তমান এমপি আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে এই আসনের সাংসদ প্রয়াত এম সাইফুর রহমানও ছিলেন অর্থমন্ত্রী। তারও আগে এ আসনে প্রতিনিধিত্বকারী হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার। তিনজনই এককালে ছিলেন দুঁদে কূটনীতিক। কূটনীতি থেকে রাজনীতিতে এসেই বাজিমাৎ করেছিলেন তাঁরা।

ভিভিআইপি হিসেবে চিহ্নিত এ আসনে মনোনয়ন জটিলতায় শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া বা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরাসরি নির্বাচন করবেন বলে কয়েকবার গুঞ্জন ওঠলেও এখনো তা হয়ে ওঠেনি। তার বদলে মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক আমলারা। তবে দীর্ঘ দিনের এ রীতির কারণে ক্ষোভ দানা বাঁধছে স্থানীয় রাজনীতিকদের মধ্যে। মাঠে তাদের কষ্টের ফসল অন্য কেউ ঘরে তুলছে বলে অভিযোগ তাদের।

এবারও সাবেক আমলাদের মধ্যে জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে কয়েকটি নাম।

আগামী নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মুহিত। রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথাও একাধিকবার জানিয়েছেন তিনি। মুহিত তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকলে কে হবেন আগামী নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী?

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অনুজ, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সপ্তম গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনের মধ্যে যে কেউ এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে পারেন বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে। তাদের মধ্যে ড. এ কে আবদুল মোমেন গত দু বছর ধরে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। বড় ভাইয়ের পক্ষে সিলেটের উন্নয়ন কাজও দেখভাল করছেন তিনি। নেতাকর্মীদের সাথেও সখ্যতা গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন সিলেট শহরের বাসিন্দা হলেও এখনো মাঠে সক্রিয় নন তিনি। তবে সিলেট আসলে দলীয় নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনের নাম শোনা গেলেও তাঁর পক্ষ থেকে এখনো কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।

তবে দলের পক্ষ থেকে এবার মাঠের কর্মীদেরই মূল্যায়ন করা হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের টানা তিন দফায় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচন করার ইচ্ছার কথা তিনি প্রকাশ্যেই নেতাকর্মীদের জানিয়েছেন। বর্তমান এমপি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পরবর্তী নির্বাচন করবেন না ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী নিজের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে।

মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, আমরা যারা রাজনীতিতে সারাজীবন ব্যয় করছি, মাঠে কাজ করি, এটা আমাদের অধিকার। জনগণ আমাদের সাথে আছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে দলীয় সিদ্ধান্ত। তার বাইরে যাবার উপায় নেই। তবু আমি মনোনয়ন পাব বলেই বিশ্বাসী।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের নামও আছে আলোচনায়। তবে সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে আগামী সিটি নির্বাচনের পর। সিটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী হলে জাতীয় নির্বাচনে নাও আসতে পারেন কামরান।

নির্বাচনে অংশ নিলে সুবিধায় থাকবে বিএনপি। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের পর আরেক সাবেক কূটনীতিক শমসের মোবিন চৌধুরীর ওপর ভরসা করছিল দলটি। কিন্তু তাঁর নিষ্ক্রিয়তার কারণে এখন মাঠে নেই কোনো আমলার নাম। সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা খন্দকার আবদুল মালিকের ছেলে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে পারেন। বেশ কয়েকবছর ধরে খন্দকার মালিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মুক্তাদির চালিয়ে যাচ্ছেন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড। তিনি দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা।

জানতে চাইলে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির বলেন, দলের পক্ষ থেকেই বলেন আর নিজের পক্ষ থেকেই বলেন, আমি গুণগত পরিবর্তন চাই। যদি লেভেল প্লেয়িং পরিস্থিতি তৈরি করে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলেই একজন রাজনীতিক হিসেবে আমি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। বিএনপির মধ্যে ঐক্য আছে, মানুষের সমর্থন আছে। আর তার কারণ হচ্ছে এই সরকার দেশের অগ্রগতির প্রধান যে ভিত্তি সেগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের অর্থনীতি বা বিচার ব্যবস্থায় বিরাজ করছে অব্যবস্থাপনা। মানুষের কথা বলার অধিকারও নাই। মানুষ এ অবস্থা থেকে উত্তরণ চায়।

তারেক রহমানের স্ত্রী সিলেটের মেয়ে ডা. জোবাইদা রহমানের নামও আছে সিলেটের নেতাকর্মীদের পছন্দের তালিকায়। তবে দলীয় সূত্র বলছে ডা. জোবাইদা রহমানের নির্বাচন করার সম্ভাবনা কম।

লড়াইটা দুদলের হলেও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও হতে পারেন একটি ফ্যাক্টর। সম্প্রতি সিলেট সফরে নগরীর রেজিস্ট্রারি মাঠের জনসভায় সিলেটকে নিজের দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে অভিহিত করে এরশাদ নিজেই জানিয়েছিলেন এখান থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী তিনি।

নির্বাচনের লড়াইটা যেমনই হোক না কেন, তার আগে রাজনীতিবিদ আর সাবেক আমলার মনোনয়ন দৌড়ে জেতাটাই এখন সিলেট-১ আসনের মূল লড়াই।

সূত্র-সিলেটটুডে২৪,কম।