ভূমিকম্পের ডেঞ্জারজোনে সিলেট। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই দশকেই সিলেট অঞ্চলে প্রবলমাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। ভৌগলিক অবস্থান ও অতীত ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে সংশ্লিষ্টরা এমন আশঙ্কাই ব্যক্ত করেছেন।

কথিত আছে, একশ’ বছর অন্তর অন্তর সিলেটে বড় ধরণের ভূমিকম্প হয়। সিলেটের সর্বশেষ ভূমিকম্প শ্রীমঙ্গলের ভূমিকম্প নামে পরিচিত। প্রায় সোয়া শ’ বছর আগে ১৮৯৭ সালের ১২ জুন এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল আট দশমিক সাত। মারা গিয়েছিলেন ৫০হাজার মানুষ। সে জন্য ব্রিটিশ আমলে সিলেট অঞ্চলে ভবন নির্মাণে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

ভূমিকম্পে প্রাণহানি এড়াতে ইটের দেয়ালের পরিবর্তে চৌচালা বেটন ও চুন-সুড়কির বসত নির্মাণে জোর দেওয়া হয়। এগুলো আসাম প্যাটানের বাড়ি বলে পরিচিত। ব্রিটিশ নির্মিত বেশীর ভাগ ভবন ছিলো আসাম প্যাটানে। ব্রিটিশ চলে যাবার পর সিলেটে সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়ে। তবে আশির দশক পর্যন্ত সিলেটে পাঁচতলা থেকে উঁচু ভবন দেখা যায়নি।

নব্বইয়ের দশকে বহুতল ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়ে। অলস অর্থ, পাউণ্ড-ডলারের আয়ে সিলেটে একে একে গড়ে উঠে আকাশ ছোঁয়া ভবন। একতলা বাড়ি ভেঙ্গে বিশাল সুউচ্চ ভবন, খাল-দিঘী দখল করে গড়ে উঠেছে সুউচ্চ বিপনী বিতান, ডোবা-হাওরের বুক জুড়ে হাউজিং প্রকল্প। অপরিকল্পিত ভাবে নিয়ম বা নিরাপত্তা বিধি না মেনে সর্বত্র একের পর এক হাইরাইজিং বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। ফলে সবুজের ছায়া মণ্ডিত সিলেট এখন ভূমিকম্প আতঙ্কে ঝুঁকছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রিকটার স্কেলে পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেটের আশি ভাগ ভবনই ধ্বসে পড়বে। সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে এ অঞ্চলের প্রায় ৯৫ ভাগ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রাণ হারাবে ১২ লাখ মানুষ এবং টাকার অংকে ক্ষতি হবে ১৭ হাজার কোটি।

ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসার্টিয়াম ১৯৯৮-এর জরিপ অনুযায়ী ‘সিলেট অঞ্চল’ ১০০ বছরের বেশী সময় ধরে সক্রিয় ভূ-কম্পন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত সংঘটিত ১৮৩৩, ১৮৮৫, ১৮৯৭, ১৯০৫, ১৯৩০, ১৯৩৪, ১৯৪৭ ও ১৯৫০ সালের বড় ধরনের আটটি ভূমি কম্পনের মধ্যে দু’টিরই উৎপত্তিস্থল ছিল (এপি সেন্টার) সিলেটের জৈন্তা পাহাড়ে। একই উৎপত্তিস্থল থেকে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় ভূমিকম্পের ফলে সমগ্র সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ভূ-কম্পনের ইতিহাসে ‘দি গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক’ নামে পরিচিত।

সিলেটে বহুতল ভবন নির্মাণ না করার একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও ছিলো। সিলেট ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে সিলেট ভুমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূমিকম্পের একেবারে উৎপত্তিস্থলেই সিলেটের অবস্থান। ফলে সিলেটে বহুতল ভবন নির্মাণ ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। অনিরাপদ।

১৮৯৭ সালের ভয়াবহতম ভূ-কম্পনের বিস্তৃত ছিল উৎসস্থল থেকে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে। এই ভূমিকম্পের কারনে ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তন সহ সিলেট ও আসাম অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ভৌগলিক পরিবর্তন ঘটে।

সিলেটে ভূমিকম্প জনিত কারনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যাতে কম হয় সে ব্যাপারে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বিশেষজ্ঞ মহল বরাবরই তাগিদ দিচ্ছেন। বিশেষ করে নগরায়নের ক্ষেত্রে ভূমিকম্প ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড শতভাগ মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা বলছেন তারা। তবে সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন।

সম্প্রতি এক গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেটের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ভবন ধ্বসে পড়বে। এতে ক্ষতি হবে ৮ হাজার কোটি টাকার। প্রাণহানি হবে ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষের।

গবেষকদের মতে, সিলেটের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবনই অপরিকল্পিত এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে সাত বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে অধিকাংশ ভবনই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। একারণে সিলেটের মানচিত্রও পাল্টে যেতে পারে। চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে সিলেটের গ্যাস এবং তেল ক্ষেত্রগুলো। কেবল গ্যাস ফিল্ডেই ক্ষতি হবে ৯ হাজার কোটি টাকার। পরিবেশ বিপর্যয়ও নেমে আসবে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, যে টেকনোটিক প্লেটে সিলেট অঞ্চল অবস্থিত তা ক্রমেই উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে। প্রতি ১০০ বছরে তা এক মিটার সরছে। এ কারণে সিলেট অঞ্চল মারাত্মক ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টে সিলেটে প্রবল মাত্রার ভূমিকম্প হবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে।

সংশ্লিদের মতে, ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় ১০০ বছর পর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সিলেটে বড়ধরনের একটি ভূমিকম্পের পর ১০০ বছর পেরিয়ে যাওয়ায় এই আশঙ্কা বাড়ছে। এছাড়া কোনো এলাকায় বড়ধরনের ভূমিকম্পের আগে মৃদু ভূকম্পন হয়ে থাকে। আর সিলেটে এরকম মৃদু ভূমিকম্প প্রায়ই হচ্ছে।

তথ্যসূত্র- সুরমানিউজ.নেট।