বৃক্ষাচার্য, জীববিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক, অনুবাদক ও উদ্ভিদ গবেষক, নিসর্গসখা অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বলেছিলেন, “জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন আমাদের দেশে আছে, জোরেশোরেই আছে, তবে প্রাণিজগতের দিকে পক্ষপাত অধিক, উদ্ভিদজগৎ অপেক্ষাকৃত অবহেলিত। বন রক্ষা বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে, তবে একক প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকানো আর বনরক্ষা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। প্রথমটির জন্য প্রয়োজন প্রতিটি বিপন্ন প্রজাতি বাঁচানোর দায়িত্ববোধ ও প্রকৃতিপ্রেম। এখানে ভালোবাসা মুখ্য, বৈষয়িকতা গৌণ, যা আমাদের মনে আজও তেমন নিবিড় ও গভীর নয় ”

মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড়ের কোলে জন্মেছিল এই বিস্ময়কর খোকা নিসর্গবন্ধু দ্বিজেন শর্মা। প্রকৃতি ও গাছগাছালির প্রতি ভালোবাসা ও লেখালেখির কারণে যিনি উপমহাদেশের প্রকৃতিপ্রেমী প্রতিটি মানুষের কাছে এক বিস্ময়। প্রকৃতি নিয়ে তার আজীবনের ভালবাসা থেকেই দ্বিজেন শর্মাকে ‘নিসর্গসখা’ বলা হয়। বাংলাদেশে প্রকৃতি ও নিসর্গবিষয়ক লেখালেখিরও পথিকৃৎ ছিলেন দ্বিজেন শর্মা।

তিনি ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টার দিকে ৮৮ বছর বয়সে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

নিসর্গপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মার জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মে, মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড়ের কাছে শিমুলিয়া গ্রামের কবিরাজ বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মা ছিলেন ওই অঞ্চলের বিখ্যাত কবিরাজ তাই বাড়িটি আজো কবিরাজ বাড়ি বলে পরিচিত। মায়ের নাম মগ্নময়ী দেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিজেন শর্মা ছিলেন পঞ্চম।

বাবার ছিল অনেক ফুলগাছ, আম-কাঁঠালের গাছ আর বনৌষধি। লোকে বলত কবিরাজ ঠাকুর। পৌষ-মাঘের শীতে খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতেন, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়েদের ডাকতেন ‘এই উঠো উঠো, গাছে জল দাও।’ ভোরে উঠে বাবার গাছে জল দিতেন। গাছের চারাদের গায়ে জল ঢেলে দিতে দিতে খোকা বড় হল পাঠশালায় যাওয়া শুরু হল।

উদ্ভিদের প্রতি দ্বিজেন শর্মার ভালবাসা বাবার থেকেই পাওয়া। মাঝে মাঝে ছুটে যেতেন গহিন জংগলে। বাবা মানা করে বলতেন “খোকা জংগলে যেওনা সাপে কাটবে” তবুও বারবার লুকিয়ে ছুটে যেতেন তিনি।

প্রকৃতি পুত্র দ্বিজেন শর্মার মুল প্রেরণা ছিলো দেশের সর্ব বৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকুণ্ডের উৎস পাথারিয়া পাহাড়। তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনে পৃথিবীর বহু প্রকৃতাঞ্চলে পরিভ্রমণ ও সময় কাটালেও তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হৃদয়ে দোলা দিতো শৈশব স্মৃতির ঘন বনাঞ্চল আবৃত প্রকৃত প্রকৃতাঞ্চল মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়া। যেখান থেকে সৃষ্টি মাধবকুণ্ড জল প্রপাত।

বৃক্ষসখা দ্বিজেন দ্বিজেন শর্মার ডাকনাম ছিল খোকা। পড়াশোনা শুরু হয় শিমুলিয়া গ্রামের পাঠশালায়। আসামের করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুল থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক অর্জনের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন।

তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন করিমগঞ্জ কলেজ, বিএম কলেজ ও নটরডেম কলেজে। পরে মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে চাকরি করেছেন প্রায় কুড়ি বছর। এরপর দেশে ফিরে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে।

১৯৬০ সালে দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে দ্বিজেন শর্মার বিয়ে হয়। তাঁদের এক ছেলে সুমিত্র শর্মা আর এক মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা।

দ্বিজেন শর্মা শত ব্যস্ততার মাঝে দেশের বিভিন্ন এলাকাসহ রাজধানীতে অসংখ্য জায়গায় গাছ লাগিয়েছেন নিজ হাতে। তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য লড়াইও করেছেন।

প্রকৃতি ও নিসর্গবিষয়ক লেখালেখিরও পথিকৃৎ দ্বিজেন শর্মা। উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘শ্যামলী নিসর্গ’ লেখেন। বাংলা ভাষায় এরকম বই এটাই প্রথম ছিল।

গাছ, ফুল বা ফলের বর্ণনায় লিখেছেন ময়মনসিংহ গীতিকা, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীনের কাব্য থেকে শুরু করে সিলেটের লোকগীতি, কিংবা মধ্যযুগের কাব্যগাথার উদ্ধৃতি।

তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে-‘সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস’, ‘ফুলগুলি যেন কথা’, ‘গাছের কথা ফুলের কথা’, ‘এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি’, ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’, ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ’, ‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’, ‘বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা’, ‘গহন কোন বনের ধারে’, ‘হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার’, ‘বাংলার বৃক্ষ’ ইত্যাদি।

জীববিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক, অনুবাদক ও নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। গত বছর এই দিনে তিনি মৃত্যু বরন করেন। তার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ নেতা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ ওই সময় বলেছিলেন, ১৯৬০ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে পড়ার সময় দ্বিজেন শর্মাকে তিনি পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। সেইসব দিনের কথা স্মরণ করে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “তিনি ক্লাসে যা পড়াতেন, তা আর দ্বিতীয়বার পড়তে হত না। আমার প্রিয় শিক্ষক দ্বিজেন শর্মা এক সাদাকালো জীবন যাপন করে গেছেন, নীরবে-নিভৃতে তিনি গবেষণা করে গেছেন।”

দ্বিজেন শর্মা ২০১৫ সালে একুশে পদক, ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র পদক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন পরিবেশ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ তরুপল্লবের সভাপতি সেলিনা রহমান জানান, বৃক্ষাচার্য ও বরেণ্য নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ রবিবার বিকেলে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও তরুপল্লব দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার অর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার স্মৃতিচারণ করে বলেন, স্যারের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছিল আমার। তিনি ছিলেন অতি নিভৃতচারী অসাধারণ একজন মানুষ যার কাছ থেকে প্রকৃতি এবং আমরা অনেক কিছুই পেয়েছি।