সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে পাউবো’র স্থাপিত বুড়িকিয়ারি বাঁধের কারণে সিলেট ও মৌলভীবাজারে ছয় উপজেলার বাসিন্দা। গত ৮ বছর থেকে বর্ষা মৌসুমে পানিবন্ধি হয়ে পড়েন। বাঁধ অপসারণ না করা এবং হাওর ভরাট ও দখল, নদী-খাল-বিল ভরাট ও দখল থাকায় প্রতিবছরই দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পতিত হচ্ছে দুই জেলার বাসিন্দারা।

২০১০ ও ২০০৪ সালে ওই একটিমাত্র বাঁধের কারণেই দুই জেলার লাখ লাখ মানুষ দুর্ভোগের শিকার হন। পাশাপাশি ক্ষতি সাধিত হয় ১০০-২০০ কোটি টাকার মতো। ভুক্তভোগী এলাকার বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, পাউবো ও পরিবেশকর্মীদের সাথে আলাপকালে বিষয়টির ধারণা পাওয়া গেছে।

খননের অভাবে ভরাট হয়ে গেছে জেলার হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর ও কেওলার হাওর। পাশাপাশি খনন না করায় মনুনদী, কুশিয়ারা নদীসহ জেলার বড়ো বড়ো ১৪টি নদী ভরাট হয়ে গেছে অনেক আগেই। এছাড়াও কোনো কোনো স্থানে এসব নদীপার দখলও করা হয়েছে। গড়ে তোলা হয়ে বসতি ও স্থাপনা। একইভাবে ভরাট হয়ে গেছে সিলেট অঞ্চলের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী।  স্রোতের  তোড়ে নদীর পলিমাটি গিয়ে পড়ছে এসব হাওরে। ফলে নদী ও হাওরের পানিধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে উজান থেকে নেমে আসা মাত্রাতিরিক্ত পাহাড়ি ঢল।

মৌলভীবাজারে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পেছনে প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট ২টি কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীরা। এ দু’টি কারণ হলো, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বুড়িকিয়ারিতে তৈরি অপরিকল্পিত বাঁধ ও ইটভাটা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) চরম অবহেলা ও গাফিলতি। একই অবস্থা সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, জুনের শুরু থেকে যে বন্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী। মৌলভীবাজারের ৫ উপজেলার ৫ লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী। ২০০৪ সালে এ রকম বন্যা হলেও তা অঞ্চলভেদে ১৫-২০ দিন কিংবা সর্বোচ্চ ১ মাস স্থায়ী ছিলো। এবার বন্যায় ভোগান্তির প্রায় সাড়ে ৩ মাস অতিবাহিত হতে চলেছে।

পরিবেশবাদীদের মতামত, ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত জুড়ী নদী মৌলভীবাজারের জুড়ী ও কুলাউড়া হয়ে হাকালুকি হাওরে গিয়ে মিশেছে। এ কারণে ভারতীয় অংশে সামান্য বৃষ্টিপাত হলেই যৌথ বিভিন্ন নদীর মাধ্যমে পানি বাংলাদেশে গড়িয়ে আসে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের অভিযোগ, এ জেলার যেসকল স্থানে বাঁধ রয়েছে, সেগুলো সংস্কারের পাশাপাশি যদি নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হতো, তাহলে বন্যার ভয়াবহতা এতোটা বৃদ্ধি পেতো না। জেলার কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, রাজনগর ও জুড়ী উপজেলায় বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের অনেক স্থানে বন্যা শুরুর আগেই ভাঙন দেখা দেয়। বিষয়টি জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজন পাউবোকে জানালেও সংস্কারে কোনো উদ্যোগ  নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে পাউবো’র অবহেলা ও গাফিলতির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পাউবো কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, চাহিদা অনুসারে বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অনেক বাঁধে সংস্কার কাজ করা যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩ সপ্তাহ সপ্তাহ ধরে মৌলভীবাজারে হাকালুকি হাওরের বন্যার পানিতে ভাসছে বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার হাওর-সংলগ্ন গ্রামগুলো। বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে অনেকে। রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। এই তিন উপজেলায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী। একইভাবে কুশিয়ারা ও মনুনদীর পানি উপচে পড়ায় জেলা সদরের আংশিক, রাজনগর, কমলগঞ্জে আংশিক এলাকা নিমজ্জিত হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন আরও ১ লক্ষাধিক মানুষ।
এই দীর্ঘ সময়ে বন্যার জন্য অতিবর্ষণ ও উজানের ভারতীয় অঞ্চল থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পাশাপাশি হাকালুকি হাওর, জুড়ী ও কুশিয়ারা নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, জুড়ী ও কুশিয়ারা নদীর সংযোগস্থল সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের বুড়িকিয়ারিতে তৈরি ক্রসবাঁধ এবং সেখানে স্থাপিত একাধিক ইটভাটাকে দায়ী করা হচ্ছে। আর এ বাঁধের কারণেই ইতোপূর্বে দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কবলে পড়েন হাওরতীরবর্তী এলাকার উপজেলার বাসিন্দারা। বাঁধটি অপসারণের জন্য একাধিকবার আন্দোলন-সংগ্রাম করেও কোনো লাভ হয়নি।
হাওর তীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান; বড়লেখার তালিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিদ্যুত কান্দি দাস, সুজানগর ইউপি চেয়ারম্যান নছিব আলী ও বর্ণি ইউপি চেয়ারম্যান এনাম উদ্দিন জানান, আগে হাকালুকি হাওর অনেক গভীর ছিলো। অনবরত বৃষ্টি হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই হাওর পানিতে টইটম্বুর হয়ে উঠতো না। এখন দুই ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ভরে যায়। এছাড়া বুড়িকিয়ারির বাঁধ যেনো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। কুশিয়ারার মুখে ইটভাটা দিয়ে পানির গতি বাঁধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। জুড়ী উপজেলার বেলাগাঁও এলাকায় কয়েক কিলোমিটারজুড়ে হাওরের দিকে বসতি গড়ে উঠেছে। বড়লেখার হাল্লা, ভোলারকান্দি, মালাম বিলের পাশে নোয়াগাঁও. মুন্সিনগর এলাকায় দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসতি স্থাপন ও দখল করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর আয়তনের হাকালুকি হাওরকে ঘিরে আছে মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া এবং সিলেটের  গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা। হাকালুকি ও কুশিয়ারা নদীর সংযোগস্থল ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার-সংলগ্ন বুড়িকিয়ারিতে পাউবো কর্তৃপক্ষ ২০০৬ সালে একটি বাঁধ নির্মাণ করে। এই ক্রসবাঁধের কারণে হাকালুকি হাওরে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবছরই। এছাড়া এই এলাকায় একাধিক ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। এসব নানা কারণে হাওরের পানি নিষ্কাশন মারাত্মকভাবে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। হাকালুকি হাওরের পানি জুড়ী নদী হয়ে কুশিয়ারায় গিয়ে পড়ে। কিন্তু জুড়ী ও কুশিয়ারা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি হাওর থেকে বের হয়ে যাবার কোনো পথ নেই।

এ বিষয়ে পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্ত্তী জানান, কুশিয়ারা ও জুড়ী নদী খননের পরিকল্পনা আছে আমাদের। খনন করে ধারণক্ষমতা বাড়ালে সমস্যা কম হবে। বুড়িকিয়ারি বাঁধের ব্যাপারে তিনি জানান, এই বাঁধ নিয়ে সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার সাধারণজ্ঞানে যতোটুকু বুঝি, এই বাঁধের জন্য সমস্যা হলে আগেও হতো। বাঁধের কারণে সামান্য কিছু প্রভাব পড়তে পারে।