করোনায় আক্রান্ত হওয়া যেন অসুস্থতা নয়, রূপ নিয়েছে অপরাধে। উপসর্গ কিংবা পজেটিভ শনাক্ত হলেই বদলে যাচ্ছে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। পাশের মানুষটির অসুস্থতায় যেখানে মানবিক হওয়ার কথা সেখানে নিষ্ঠুর আচরণে ঘরবন্দি অবস্থায় একাকীত্ব ও বিষন্নতায় দিন কাটাচ্ছেন করোনা আক্রান্তরা। অনেকে প্রকাশও করতে চাচ্ছেন না নিজেদের শরীরের কোভিড-১৯ এর উপসর্গ থাকার কথা।

বিয়ানীবাজার পৌর এলাকার কসবা গ্রামের বাসিন্দা আরিফ আহমেদ তুহিন। ২৭ বছর বয়সী এ তরুণ চাকুরি করেন একটি ওষুধ কোম্পানিতে। চাকুরির প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কয়েকদিন পূর্বে নিজের সন্দেহ থেকে স্বেচ্ছায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসেন তিনি। গত শনিবার রাতে তার করোনার রিপোর্ট পজেটিভ শনাক্ত হয়। এরপরই শুরু হয় সামাজিক হেনস্তা। প্রতিবেশী এমনকি পরিচিতজনদের কটুক্তি ও বিরূপ মন্তব্যের শিকার হতে হচ্ছে তাকে। আরিফ বলেন, করোনা পজেটিভ ধরা পড়ার পর থেকে আমাকে, এমনকি আমার পরিবারের সদস্যদেরকে ফোন করে অনেকেই নেতিবাচক ও বিরূপ মন্তব্য করছেন। এতে আমরা মানসিক অশান্তিতে ভুগছি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস একটা রোগ। আজ আমার হয়েছে, কাল হয়তোবা অন্য কারো হতে পারে। তাই অনুরোধ জানাচ্ছি, এই রোগটা নিয়ে কোন ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল কিংবা কাউকে সামাজিকভাবে হেনস্থা করবেন না।

এমন অমানবিক ঘটনা শুধু আরিফের বেলায়ই ঘটছে না, প্রায়ই শিকার হচ্ছেন অনেকে করোনা রোগীরা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিরুপ আচরণের শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন প্রয়োজনে জেলার বাইরে থেকে আগতরা। প্রতিবেশিরা স্থানীয় হওয়ায় মুখ খুলতেও ভয় পাচ্ছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার বাইরে থেকে আসা এক করোনা পজেটিভ রোগীর স্বজন জানান, অনেকেই মুঠোফোনে কল দিয়ে অশ্লীলভাবে গালিগালাজ করেছেন। অনেকেই বিয়ানীবাজার ছেড়ে চলে যেতেও বলছেন।

আক্রান্তদের প্রতি মানবিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে জনপ্রতিনিধি ও স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীলদের অব্যাহত প্রচারণা কিছুতেই কাজে আসছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানা কিংবা আক্রান্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণের এমন অনুরোধ কানে তুলছেন না কেউই। অন্যদিকে, সামাজিকভাবে হেনস্থার ভয়ে নিজের শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা স্বত্তেও নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। এতে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন আরও ভয়াবহ রূপে বিস্তার লাভ করবে- এমনটাই আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।

আক্রান্তের প্রতি আশপাশের মানুষের এমন বিবেকহীন আচরণ কাম্য নয় বলছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আবু ইসহাক আজাদ। আর রোগীর কাছ থেকে দূরে থাকার প্রবণতায় যেন, আক্রান্ত ব্যক্তিকে একঘরে করে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ এই চিকিৎসকের। তিনি বলেন, করোনার এ মহামারীর সময়ে আমরা যেন অমানবিক হয়ে না উঠি। এ সময়টা পারস্পরিক সহযোগিতা, আক্রান্ত ব্যক্তিকে মানসিক সাহস দেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত কোনো আচরণ করা যাবে না। কারণ আপনি-আমি যে কেউ আক্রান্ত হতে পারি। আমার সঙ্গেও যদি এ ধরনের আচরণ করা হয়, তাহলে কেমন লাগবে- সেটা ভাবা উচিত। এ সংকট মোকাবেলায় ভীত নয়, সবাইকে সতর্ক হতে হবে।

ডা. আবু ইসহাক আজাদ আরও বলেন, বিশ্বে এখনো করোনার এন্টিবডি তৈরি না হওয়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর মনোবল শক্ত করার তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। আর এ জন্য পাশে থাকতে হবে প্রতিবেশি, পরিচিতজন এমনকি কাছের মানুষদেরই। তাই তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করা উচিত।

এদিকে, বুধবার বিকাল ৩টায় এ প্রতিবেদন লিখা পর্যন্ত বিয়ানীবাজারে ২৪ জন করোনা রোগী শনাত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে প্রথম ৫জন সুস্থ হয়ে গেছেন। অন্য আক্রান্তরা শারিরীকভাবে মোটামুটি সুস্থ রয়েছেন।

বিস্তারিত ‘এবি টিভি’র প্রতিবেদনে দেখুন-