সিলেট নগরীর একটি রেস্তোরাঁয় গত মাসে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন মিথিলা ও তাহের (ছদ্মনাম)। বিয়ের কাবিন, কবুল বলা, খাওয়া দাওয়াসহ বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বর চলে গেছেন বরের বাসায়। আর কনে চলে গেছেন কনের বাসায়। কারণ বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও এটা সত্যিকারের বিয়ে না। এটা একটা ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ বা ‘চুক্তি বিয়ে’।

অনুসন্ধানে জানা গেল, বর তাহেরের আইইএলটিএস স্কোর ভালো। ২০২২ সালের শেষে শিক্ষা ভিসায় যুক্তরাজ্যে কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়তে যাওয়ার আবেদন করবেন। এজন্য তার ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা লাগবে। যুক্তরাজ্য এখন বিবাহিত শিক্ষার্থীদের ‘স্পাউস’ নেওয়া সুযোগ দিচ্ছে। তাই এই সুযোগ কাজে লাগাতে তাহের কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের চিন্তা করেন। এরপর পরিচিত একজনের মাধ্যমে কনে যোগাড় করেন। বিয়ের যাবতীয় খরচসহ যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সকল খরচ বহন করবে কনে পক্ষ। ভিসা পাওয়ার পর বর তাকে সাথে যুক্তরাজ্য নিয়ে যাবেন। সেখানে গিয়ে তারা নিজেদের মত করে আলাদা থাকবেন। এভাবেই চুক্তিতে বিয়ে হয়েছে তাদের।

সাম্প্রতিক সময়ে বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জসহ সিলেটজুড়ে এই ধরনের চুক্তি বিয়ে বেড়েছে। সিলেটের বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ বা ‘চুক্তি বিয়ে’ একটা সময় বাংলাদেশে অপ্রচলিত ছিল। তবে এই শব্দটা সিলেটীদের কাছে পরিচিত ছিল অনেক আগে থেকে। ২০০৫/০৬ সালে সিলেটে ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সিলেটের যুবকরা ওর্য়াক পারমিট বা ভিজিট ভিসায় লন্ডন যেতেন। সেখানে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তারা সেখানকার নাগরিক কোনো মেয়েকে ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ করতেন। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে মেয়েটি ছেলেটিকে লন্ডনের নাগরিকত্ব পাইয়ে দিতেন। পরে তারা ডিভোর্স নিয়ে নিজ পছন্দের মেয়ে/ছেলেকে বিয়ে করতেন। বর্তমানে একই ভাবে সিলেটে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ বেড়েছে।

কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করেছেন এমনই একজন সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাও ইউনিয়নের মৌসুমি (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, লন্ডনে আমার ভাই ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আছেন। তাই আমি কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করেছি। আমার পরিবারও এতে সম্মতি দিয়েছে। এর জন্য ভিসা ও বিয়ের যাবতীয় খরচ আমার পরিবার বহন করেছে। ডিপেন্ডেন্ট হিসেবে আমার ভিসা হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যেই আমি লন্ডন চলে যাব।

স্টুডেন্ট ভিসায় গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের সেবা প্রদানকারী একাধিক এজেন্সির সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের বাসিন্দারা যুক্তরাজ্যে বেশি থাকায় শিক্ষার্থীরা সেখানে ‘শিক্ষা ভিসা’ পেতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। এতে করে ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ এর ক্ষেত্রেও পাত্র পাত্রী সহজে পাওয়া যায়। এছাড়া ‘শিক্ষা ভিসা’ ও ইমিগ্রেশন শর্ত শিথিল করা এবং বিবাহিত শিক্ষার্থীদের ‘স্পাউস’ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া সিলেটে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’। ব্যাপারটা এতটাই স্বাভাবিক, ও বাণিজ্যিক হয়েছে যে, পাত্র, পাত্রী, বিয়ের ঘটক বা দালালরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন বিয়ের পেইজ, গ্রুপে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের জন্য পাবলিক পোস্ট করেন।

গত ২ অক্টোবর ‘সিলেটী বিয়া-শাদী ডটকম গ্রুপ’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে মায়া ইসলাম নামক একটি আইডি থেকে ওই গ্রুপে পোস্ট দেওয়া হয় ‘পাত্র_চাই ( Contract Marriage ) আমি একজন পাত্র চাচ্ছি স্টুডেন্ট ভিসায় ডিপেনডেন্ড হয়ে Uk যাওয়ার জন্য। অনার্স কমপ্লিট এবং ইংরেজিতে স্মার্ট IELTS এ ভালো রেজাল্ট পেয়েছেন এবং UK ইউনিভার্সিটি থেকে অফার পেয়েছেন এমন কেউ থাকলে ইনবক্স করুন। ইউনিভার্সিটি খরচ দুই পক্ষ কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। একই গ্রুপে একই দিনে সুলতানা খানম নামের একটি আইডি থেকে পোস্ট দেওয়া হয় ‘একজন পাত্রী খুজতেছি আমার ভাই এর জন্য January session এ এপ্লাই করেছেন/ অফার লেটার চলেএসেছে- এই রকম একজন মেয়ে চাই..আমার ভাই Dependent হয়ে UK যাবে। Contact marriage বা Real marriage হবে. খরচ আলোচনা সাপেক্ষ বহন করা হবে, কোনো বোন থাকেন তাহলে আমাকে ইনবক্সে মেসেজ দিবেন প্লিজ।’

গত ১৯ জুলাই ফাহমি রহমান নামে একজন ‘সিলেট বিভাগীয় বিবাহ বন্ধন মেরিজ মিডিয়া’ গ্রুপে পোস্ট দেন ‘•কন্টাক্ট মেরেজ ফর UK. NEED a female dependent…এমনকেউ( female) আছেন কি? যে একজন ছেলে student er সাথে dependent হয়ে uk তে যেতে চান। Student er ielts and hons complete. Offer letter চলে আসছে, এই মাসের শেষের দিকে টিউশন ফি পে করা হবে। cost…আলোচনা সাপেক্ষে।only inbox plz’

বেশ কয়েকটি বিবাহ গ্রুপ ও পেইজের বিগত কয়েক মাসের ফেসবুক পোস্টে দেখা যায়, বেশির ভাগ মানুষ শিক্ষা ভিসায় ডিপেন্ডেট হিসেবে নেওয়ার জন্য কন্ট্রাক্ট ম্যারিজ করতে চায় এমন পাত্র-পাত্রী খুঁজছেন। তবে অনেকে একই ভিসায় সাথে যাওয়ার জন্য রিয়াল বিয়ে করে পাত্র-পাত্রী নেওয়ার জন্য ও পোস্ট দিয়েছেন।

সিলেটে শিক্ষা ভিসা প্রসেসিং সংক্রান্ত সংগঠন ‘ফরেন এডমিশন এন্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র তথ্য মতে, ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা ভিসায় আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী, ২০২১ সালে ১১ হাজার শিক্ষার্থী ও ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ গিয়েছে।

ফরেন এডমিশন এন্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. ফেরদৌস আলম বলেন, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ দেয়। এই মুহূর্তে সারা দেশের মধ্যে সিলেটের শিক্ষার্থীরাই দেশের বাইরে বেশি যাচ্ছেন শিক্ষা ভিসায়। পারিবারিক কারণে সিলেটিদের ইংল্যান্ড যাওয়ার প্রবণতা বেশি তাই সিলেটের শিক্ষার্থীরা ইউকেতে বেশি আবেদন করছেন। এছাড়া আমরা যদি অন্যান্য জেলার শিক্ষার্থীদের কথা বলি তারা অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ অন্যদেশে আবেদন করছেন।তবে স্পাউসের একটা লিমিটেশন হচ্ছে মাস্টার্স প্রোগ্রাম না হলে কেউ স্পাউস নিতে পারে না।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের যেকোন অঞ্চলের তুলনায় সিলেটের চারটি জেলা থেকে বৈধ বা অনিয়মত পন্থায় যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। পড়তে বা বৈধ ভিসায় বিদেশ যাওয়াটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এটিকে কেন্দ্র করে যদি টাকার বিনিময়ে চুক্তিতে বিয়ে হয় সেটি দুঃখজনক। কেউ একজন পড়তে যাচ্ছেন তিনি যদি টাকার বিনিময়ে চুক্তিতে স্বামী বা স্ত্রী বানান তাহলে সেটি কিন্তু এক ধরনের বাণিজ্য। এমন ঘটনা বাড়তে থাকলে সত্যিকার ভাবে যারা পড়তে যাবেন বা যারা সত্যি স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে যেতে চান তারা কিন্তু সংকটে পড়বেন। অনেকের ভিসা পেতে দেরি হবে। আর টাকার বিনিময়ে এভাবে স্বামী স্ত্রী বানিয়ে বিদেশে নেওয়া এক অর্থে পাচারও। এ বিষয়ে সিলেটের স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সবাই মিলে সচেতনতা কার্যক্রম নেওয়া উচিত’।

তথ্যসূত্র- সিলেটটুডে২৪।

‌বিয়ানীবাজারের রাজবাড়ি ডেইরি ফার্ম- গো-খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে লোকসানে খামারি কালাম