শেষ হলো পঞ্চখণ্ডের বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ের। সুপারনোভায় ধ্বংস হওয়ার পথেই নক্ষত্ররা যেভাবে দ্যুতি ছড়ায়, পঞ্চখণ্ডের জল হাওয়ায় তেমনই উজ্জ্বল হয়ে থাকবে এক কিংবদন্তির জীবন আখ্যান। শুক্রবার সন্ধ্যায় মেঘের প্রাচীর ভেঙ্গে প্রাচ্যের নবদ্বীপের আকাশ থেকে খসে পড়লো আরেকটি নক্ষত্র। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে পঞ্চখণ্ড দেখলো তার সন্তান সবুজ মৃত্তিকা ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে অজানা গন্তব্যে, অদেখা ভূবনে। আশির দশকের কবি ফজলুল হকের প্রস্তানের পর এবার বিদায় নিলেন অধ্যাপক একে এম গোলাম কিবরিয়া তাপাদার। বিদায় হে কিংবদন্তি।

তিনি মুখভরা পান চিবিয়ে যখন কথা বলতেন সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। মঞ্চে বক্তা হলে অগণিত শ্রোতা তাঁর ধরাজ কণ্ঠের সাবলীল উচ্চারণ, ছন্দময় কথাগুলো শোনতেন নিরবে। অমোঘ নিয়তি সেই কণ্ঠকে স্তব্ধ করেছিলো কয়েক বছর আগে। এবার জীবন নিয়মের সেই খেলায় চিরতরে চলে যাচ্ছেন পঞ্চখণ্ড ছেড়ে।
মুড়িয়া হাওরের জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা কিশোর বন্ধুদের মধ্যমনি ছিলেন। বন্ধুরা তাকে সেলিম নামে ডাকতো। বন্ধুদের প্রিয় সেলিম গ্রামের গন্ডি পেরিয়ে যখন বেরিয়ে আসলেন ধীরে ধীরে সেলিম নামটিও হারিয়ে গেল। হয়ে উঠলেন পঞ্চখণ্ডের গোলাম কিবরিয়া।
প্রাচ্যের নবদ্বীপের এ কিংবদন্তি স্বপ্ন দেখতেন একদিন শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষক কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গনের সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভরা বর্ষায় মুড়িয়া হাওরে সাঁতার কাটবেন। নৌকায় করে দেখবেন দিগন্ত বিস্তৃত হাওরের রূপ সৌন্দর্য কিংবা পশ্চিমাকাশে লাল সূর্যের অস্ত যাওয়া। হাওরের বুকে আবির সন্ধ্যায় আকাশের লাল আভায় মুগ্ধ হবেন সবাইকে নিয়ে। কিন্তু তাঁর যে স্বপ্ন পুরণ হয়নি। তিনি চলে গেলে অনন্তলোকে।

এসএসসি পরীক্ষা শেষে পরিবারের আর্থিক যোগান দিতে ডাক পিয়নের চাকরিতে যোগদান করেন গোলাম কিবরিয়া। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় বাড়তি এ দায়িত্ব নিজে থেকে নিয়েছিলেন। ইচ্ছে বাবাকে সাহায্য করা, পরিবারের কিছুটা স্বচ্ছলতা নিয়ে আসা। জীবনের ভাঙ্গা গড়া খেলায় এভাবে নিজেকে ভেঙ্গে গড়ে তৈরী করেছেন কিংবদন্তিতে। এক সময়ে হয়ে উঠলেন পঞ্চখণ্ডের ভরপুত্র। তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো দেশ ও দেশের বাইরে।

পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রী পাশ করে ভর্তি হন জগন্নাত কলেজে (জগন্নাত বিশ্ববিদ্যালয়)। সেখান থেকে মাস্টার্স পূর্ণ করে বিয়ানীবাজার মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি কুড়ারবাজার মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে তাঁর চাকরি সরকারিকরণ হলে তিনি পূনরায় বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রথম মেয়াদে তিনি সিলেট শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে শিক্ষা বোর্ডে সচিব ও চেয়ারম্যান হিসাবে পদে পদোন্নতি পান। চাকরি জীবনের ইতি টানেন সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে।

পঞ্চখণ্ডের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করতে চেয়েছিলেন। শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি আরো দৃঢ় করতে কত পরিকল্পনা ছিল তার। আক্ষেপও ছিল অনেক। কিন্তু দূরারোগ্য ব্যাধি তার পথে কাঁটা হয়ে দাড়ায়। শারিরীক সুস্থতার আশায় দেশও দেশের বাইরে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হয়েছে। দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন হাসপাতাল কেবিনের চার দেয়ালের ভেতর।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক হওয়ার পর পাড়ি জমান সিলেট শহরে। এরপরও প্রতি সপ্তাহে ছুটে আসতেন বিয়ানীবাজারে। সকাল ও দুপুর কাটাতেন ছোটদেশ গ্রামের হাজিটিলার নিজ বাড়িতে। বই পড়া, ঘরের সামনের এক চিলতে জায়গায় গড়ে তোলা ফুলের বাগানের পরিচর্যা করতেন। দুপুরে বাড়ির উঠোনের আম গাছের ছাড়ায় বিশ্রাম নিতেন। বিকাল হলে ছুটে আসতেন পৌরশহরে। পঞ্চখণ্ড গোলাবিয়া লাইবেরি, সাংস্কৃতিক ক্লাব কিংবা বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে মেতে উঠতেন আড্ডায়। এসব আড্ডায় তিনি স্বাভাবিকভাবে হয়ে উঠতেন মধ্যমনি।

কালের নিয়মে তাকে পাড়ি দিতে হচ্ছে অনন্তলোকে। রঘুনাথ শিরোমনি, সুভাষ পণ্ডিৎ, অনিপণ্ডিৎ, মহেশ্বয়র ন্যায় লংকার, ড. জিসি দেবের উত্তরসূরী হয়ে থাকবেন ইতিহাসের পাতায়। বিদায় হে কিংবদন্তি অধ্যাপক একেএম গোলাম কিবরিয়া তাপাদার।

‌অধ্যাপক গোলাম কিবরীয়া তাপাদার আর নেই- পঞ্চখণ্ডের আরেক নক্ষত্রের পতন