১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ইতিহাসের বেদনাবিধুর ও বিভীষিকাময় এক দিন। এইদিনে অতিপ্রত্যুষে ঘটেছিল ইতিহাসের কলঙ্কজনক ঘটনা। সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী সৈনিকের হাতে সপরিবারে প্রাণ দিয়েছিলেন বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নৃশংস ঘটনায় কলঙ্ক পড়ে সিলেটবাসীর উপর। স্টেনগান দিয়ে জাতির জনকের বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়া ঘাতক নূর চৌধুরীই কলঙ্কিত করেন পূণ্যভূমি সিলেটকে।

ইতিহাসের এই নৃশংস খুনি নূর হোসেনের বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লাউয়াই (উম্মরকবুল) গ্রামে। বঙ্গবন্ধু হত্যার দীর্ঘ ৪৩ বছর পরও আত্মস্বীকৃত এই খুনির বিচার না হওয়ায় কলঙ্কমুক্ত হচ্ছেন না সিলেটবাসী।

জাতির জনকের এই খুনিকে দেশে এনে ফাঁসি কার্যকর করে কলঙ্কমুক্তি চান সিলেটবাসী। রায় কার্যকরের মাধ্যমে সিলেটসহ সারাদেশ কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে মুক্তি পাবে বলে মনে করছেন তারা। এজন্য কানাডা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব ঘাতক নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করার দাবি তাদের।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লাউয়াই গ্রামে নূর চৌধুরীর পরিবারের স্মৃতি হিসেবে রয়েছে কেবলমাত্র একটি ছোট্ট ঘর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ওই বাড়িতে নূর চৌধুরীর পরিবারের আর কারও পা পড়েনি। নূর চৌধুরীকে এলাকার নতুন প্রজন্মরা না দেখলেও তাকে জানেন ইতিহাসের এক ঘৃণিত খুনি হিসেবে।

এদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডে দণ্ডিত নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরাতে কানাডার ফেডারেল কোর্টে আইনি লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশও।

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, যতদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হত্যার পলাতক ৬ ঘাতকের ফাঁসি কার্যকর হবে না; ততোদিন পর্যন্ত বাঙালি জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে না। যতদ্রুত সম্ভব তাদের অবস্থান সনাক্ত করে দেশে এনে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে।

এছাড়া ঘাতক নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কানাডার সাথে আইনী প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে বর্তমান সরকারকে আহ্বান জানান আসাদ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত নূর চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর না হবে; ততোদিন পর্যন্ত সিলেটবাসী কলঙ্কমুক্ত হবে না।

সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে কানাডার সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন নূর চৌধুরী। সেই আবেদন রিফিউজ করে দেশটির সরকার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা হলে কানাডার ফেডারেল কোর্টে একটি আপিল আবেদন করেন নূর চৌধুরী। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের মে মাসে ফেডারেল কোর্টে আইনি লড়াইয়ে অংশ নেয় বাংলাদেশও।

২০০২ সালে কানাডার অভিবাসন ও শরণার্থী বোর্ড নূর চৌধুরী ও তার স্ত্রীকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তার অপরাধ ছিল শান্তি ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে। ২০০৩ সালে কানাডার ফেডারেল কোর্ট নূর চৌধুরীর আবেদন খারিজ করে এবং অভিবাসন বোর্ডের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। ২০০৬ সালে কানাডা ত্যাগ করতে বলে অভিবাসন বিভাগ।

২০১১ সালের একটি সাক্ষাৎকারে নূর চৌধুরী ও তার আইনজীবী বলেন, তাদের আবেদনে কোর্ট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কানাডার সরকার দেশ ত্যাগ করার বিষয়ে কিছু বলতে পারে না।

কূটনৈতিক সূত্রে জানায় গেছে, ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি কানাডার বাংলাদেশ হাই কমিশন নূর চৌধুরীর অবস্থান জানতে চেয়ে দেশটির সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে একটি চিঠি দেয়। এই তথ্য জানার জন্য বাংলাদেশের জনগণ আগ্রহী বলে ওই চিঠিতে গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশ হাইকমিশন। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে আপত্তি ও কানাডার প্রাইভেসি অ্যাক্টের কারণে দেশটির মন্ত্রী এ বিষয়ে তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।

সূত্র আরও জানায়, ২০১৬ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কথা বলে। যার প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও কানাডার কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের মাঝে আলোচনা হয়। তবে মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে কানাডার আপত্তি ও বাংলাদেশের সঙ্গে কানাডার তথ্য বিনিময়-সংক্রান্ত চুক্তি না থাকায় সে বিষয়ে দেশটির কিছুই করার নেই।

জানা গেছে, চলতি বছরের ২৯ মার্চ বাংলাদেশ হাইকমিশন দুই দেশের তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করার জন্য আলোচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। গত ৮ মে দেশটির সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জানান, কানাডায় প্রাইভেসি অ্যাক্ট অনুযায়ী অভিবাসন, শরণার্থী ও নাগরিকত্ব বিষয়ক কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির লিখিত অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা সম্ভব নয়।