ইবন একটু একটু কথা বলছে এখন। সে ধীরে ধীরে তার কাহিনী বলছে, আমি শুনছি আর শিহরিত হচ্ছি তার বন্ধুদের কথা শুনে। এক্সিডেন্টের সময় সে ঘুমে ছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখে এক হাতে শক্তি নাই। রক্তে ভিজে গেছে পুরো শরীর। বাস থেকে নামিয়ে ২০ মিনিট রাস্তার উপর বসা। তার বন্ধুরা পুলিশ, সিএনজি যোগাড় করেছে হাসপাতালের খোজে।

এসময় তার বন্ধুদের ২ জনের মোবাইল নাম্বার পাওয়া যায়। আমরা তাদের সাথে কথা বলি। ভোর তখন ২টা। আমাকে তার বন্ধু বলে, ইবনের বেশি কিছু হয় নাই, হাতে একটু সেলাই লাগবে। অপর একজনের অবস্থা বেশি খারাপ। সীতাকুন্ডুর হাসপাতালে ড্রেসিং হয়। পরে এম্বুলেন্সে করে যখন চট্টগ্রাম মেডিক্যালে নেয়া হয় তখন চিন্তায় পড়ি। তার বন্ধু বলে – আংকেল, ইবন ঠিক আছে, অরে ব্যান্ডেজ দিয়ে দিয়েছে, আরেকজনের জন্য আমরা চিটাগাং মেডিক্যালে যাচ্ছি।

এখন শুনলাম, তার জন্যই বন্ধুরা চিৎকার করে কান্নাকাটি করেছে। চিটাগাং আড়াই ঘন্টা সেলাই দিয়েছে, তার শার্ট প্যান্ট বদলে অন্যের জামা পরিয়েছে ঢাকা পাঠানোর আগে। এসব খবর বন্ধুরা আমাদের কাছে গোপন করেছে ফোনে।

আমি কুমিল্লায়, জলি আর ইশমাম ঢাকায়। আমাদের ফোন একসময় কেউ ধরে না। অনেক পরে ধরলে স্বাভাবিক গলায় বলেছে- সামান্য হাত কেটেছে, সেলাই দিয়েই নিয়ে আসছি। এখন শুনলাম – কঠিন কান্না থামিয়ে তারা কথা বলেছিল আমাদের সাথে।

ভালো বাসে আসার টাকা তাদের কাছে ছিল। কিন্তু এক সাথে ৯টা সীট পায়নি বলে এই ‘ইয়ার ৭১’ বাসে তারা টিকেট কাটে। কোন দুজন সামনে বসবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতায় জিতে ইবন ও হাবিব। সামনের সীটের কে জানালার পাশে বসবে এই প্রতিযোগিতায় জিতে ইবন, হারে হাবিব। আর কে সবচেয়ে বেশি আহত হবে এই আয়োজনেও জিতে ইবন সেকেন্ড হয় হাবিব, যে ফার্স্ট এইড নিয়ে বাসায় বিশ্রামে।

আজ রাতে ইবনের পুরো স্মৃতি এসেছে। কাল যে তার অপারেশন হয়েছে এটাও মনে করতে পারছে না।

আজ সে ফেইসবুকে ঢুকেছে, বিশ্বকাপের খেলার খবরও নিচ্ছে। শীষ দিচ্ছে, ওর ধারনা ইন্ডিয়া বিশ্বকাপ নেবে। অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ড রানার্রস আপ।

পুণশ্চঃ ভাবুনতো, এক কিশোর রক্তাক্ত অবস্থায় মহাসড়কের পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। তার হাত, মুখ, গলা, বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। তাকে হাসপাতালে নেয়ার কোন গাড়ি নাই। পুলিশের এক গাড়ি আসে। তারা বলে – এম্বুলেন্স ডাক। তারা নেয় না। কিশোর শুয়ে থাকে, তার বন্ধুরা গায়ের জামা খুলে রক্ত চাপা দিতে চেষ্টা করে।

বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান, অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মাহমুদ যিনি ফেরেস্তারূপে আবির্ভুত হোন (এবং নিজ দ্বায়িত্বে বন্ড সই করে নিজে টিকেট কেটে এই দশ কিশোরকে নিয়ে বিমানে করে ঢাকা আসেন), চমেকের ডাক্তার গৌতম যাঁরা এই কিশোরদের যথাসময়ে সর্বোচ্ছ চিকিৎসা সেবার বন্দোবস্ত করেন। আর এসব সমন্বয় করে ডা. মেজবাহ। কৃতজ্ঞতা।

লেখক- স্থপতি ও নাট্যকার।