মৌলভীবাজারের বড়লেখার ৫টি ইউনিয়নে বিশেষ করে হাকালুকি হাওরপারের তিন ইউনিয়নে বন্যার পানি কমলেও বেড়েছে দুর্ভোগ। নৌকা দেখলেই ত্রাণ না পাওয়া মানুষজন দৌঁড়ে এগিয়ে আসেন, কেউ কি তবে ত্রাণ নিয়ে এলো। ভীড় জমে মানুষের। গত শনিবার পুরোদিন হাওর এলাকা সরেজমিনে ঘুরে ত্রাণবঞ্চিত মানুষের সাথে কথা বলে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে এখনও ৮০ ভাগ মানুষ ত্রাণ পায়নি। সরকারিভাবে যে ত্রাণ দেয়া হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। যে ২০ ভাগ পেয়েছে তার বেশিরভাগই বেসরকারি সংস্থা কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে।

সরেজমিনে তালিমপুর ইউপি’র হাল্লা, পূর্ব হাল্লা, খুটাউরা, আহমদপুর, নুনুয়া, দুর্গাপুর, শ্রীরামপুর, মুর্শিবাদকুরা, গগড়া, পশ্চিম গগড়া, কটালপুর এলাকায় এখনও ত্রাণ পায়নি শত শত মানুষ।

উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি, রাঙ্গিনগর, দশঘরি, বাড্ডা, ব্রাহ্মণেরচক গ্রামেও ত্রাণ পায়নি অনেকে। এসব এলাকার বেশিরভাগ বাড়িঘর এখনও পানিতে নিমজ্জিত আছে। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে আছে। যানবাহন চলাচলও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। বাহন হিসেবে নৌকাই ভরসা এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের।

হাওরপারের দুর্গত মানুষের জন্য উপজেলা প্রশাসন তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় ও হাকালুকি সপ্রাবি এবং সুজানগর ইউপি’র ছিদ্দেক আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও আজিমগঞ্জ সপ্রাবিতে আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেয়। এই ৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে শতাধিক পরিবার আশ্রয় নেয়। বর্তমানে পানি কমায় অর্ধশত পরিবার নিজ বাড়িতে ফিরে গেছে। তবে হাওরপারের লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দী অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। বোরো ধান, আউশ, সবজি ক্ষেত হারিয়ে নি:স্বদের নীরব কান্না চলছে। দেখা দিয়েছে গোখাদ্য সংকট। হাওরে প্রচ- ঢেউ থাকায় মাছও ধরতে পারছে না মৎস্যজীবি পরিবারের লোকজন। সীমাহীন দুর্ভোগের পাশাপাশি আর্থিক অনটনে মানবেতর জীবন-যাপন করছে হাওর এলাকার লোকজন। হাওরের ভেতরে যাদের বাড়ি রয়েছে আফাল তথা ঢেউ ভয় তাড়া করে সব সময়। অনেকের বাড়িঘর ঢেউয়ের প্রচ- আঘাতে ভেঙ্গে ও তলিয়ে যাওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোই এখন কঠিন। দফায় দফায় মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণে হাওরতীরবর্তী বাসিন্দাদের দুর্ভোগ পিছু না ছাড়ায় গত প্রায় সাড়ে ৩ মাস থেকে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আর গত একমাস থেকে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়ে হাহাকার বেড়েছে হাওর তীরবর্তী মানুষের মধ্যে।

হাওর এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা শুধু মুখ চিনে ও যারা ভোট দিয়েছে তাদেরকেই ত্রাণ দিচ্ছেন। কেউ-ই তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি এতোদিনেও। বানভাসীদের নিয়েও যে রাজনীতি চলছে তা সরেজমিনে গিয়েই জানা গেলো।
হাওর তীরবর্তী মানুষের দাবি, ফেঞ্চুগঞ্জের বুড়িকিয়ারি বাঁধ অপসারণ ও হাওর খনন না করলে এ দুর্ভোগ থেকে রেহাই মিলবে না। এমনকি সিলেট বিভাগের অন্যান্য হাওরগুলোতে যেভাবে হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সেভাবে হাকালুকির উন্নয়নে কোনো ভূমিকা নেয়া হয়নি।

তালিমপুর ইউপি’র আহমদপুর গ্রামে হাওরের তীরে ১৫টি পরিবারের বাস। বাসিন্দা বৃদ্ধা রেবতি বিশ্বাস, রাজন বিশ্বাস, রায়মোহন বিশ্বাস, চঞ্চলা বিশ্বাস প্রমুখ অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন থেকে চরম দুর্ভোগ পোহালেও কেউ ত্রাণ দেয়নি। বাড়িঘর ভেঙে যাচ্ছে ঢেউয়ের আঘাতে। কেউ কিছু না দিলেও ইউপি চেয়ারম্যান একদিন তাদের একদিন দেখে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, সাহায্য করবেন, কিন্তু এখনও কিছু দেননি।

পশ্চিম মুর্শিবাদকুরা গ্রামে হাওরের তীরে ৬টি পরিবার। সুবেদা বেগম, মিনারা বেগম, ছালিক আহমদ, ফারুক আহমদ, কালা মিয়া, মঈন উদ্দিন প্রমুখ অভিযোগ করেন, কোনো ত্রাণ সহায়তা পাননি তারা। তবে কিছুদিন আগে একটি সংস্থার পক্ষ থেকে চিড়া, মুড়িসহ অন্যান্য সামগ্রি পেয়েছেন। জীবিকা নির্বাহ করছে হাওরে মাছ ধরে। কিন্তু ঢেউয়ের কারণে মাছও ধরা যাচ্ছে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তারা।

ত্রাণবঞ্চিত ছাবির হোসেনের স্ত্রী সুলতানা বেগম, নূর আলীর স্ত্রী নাদিয়া বেগম নৌকা দেখতেই দৌঁড়ে এগিয়ে এলেন। চোখ মুছে মুছে জানালেন তারা, এতোদিনেও তারা কোনো ত্রাণ পায়নি।

খুটাউরা গ্রামের কালাই মিয়া, ছত্তার মিয়াসহ অনেকেই জানালেন, তারা সরকারিভাবে কোনো ত্রাণ পাননি। তবে কিছু যুবক তাদের একদিন ত্রাণসামগ্রি দিয়েছে। পরিবার নিয়ে বেশ কষ্টেই দিন কাটাচ্ছেন তারা।

পূর্ব হাল্লা গ্রামের মঈন উদ্দিন, ছরকুম আলী, জয়নাল মিয়া প্রমুখ জানান, কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। এখন পর্যন্ত কোনো কিছু দেয়া হয়নি তাদের।

দুর্গাপুর এলাকার বাসিন্দা নজিব আলীর ছেলে ফখর উদ্দিন পক্ষাঘাতগ্রস্থ লোক। পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তিনি জানান, চেয়ারম্যান ও মেম্বারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ত্রাণ পাননি।

মুর্শিবাদকুরা গ্রামের সুবেদা বেগমকে দেখা গেলো এক ছেলে কোলে ও অন্য ছেলেকে নৌকায় বসিয়ে দ্রুত পার্শ্ববর্তী অপেক্ষাকৃত উঁচু বাড়িতে উঠছেন। জানালেন, হাওরে আফাল (ঢেউ) উঠছে। ডরাইয়া (ভয়ে) হুরুতা (সন্তান) নিয়ে নিরাপদে আইলাম (আসলাম)।
এমনই অবস্থা এখন হাওরে। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ঘরের ভিটায়। ঘরের বেড়া ভেঙে পানির স্রোতে মিশে যাচ্ছে। বাড়িঘরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকে ঝুঁকি সত্ত্বেও বাড়ি ছাড়ছেন না। সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেকের ভিটেবাড়ির মাটি পানির তোড়ে ভেসে গেছে। ঘরের বেড়া ভেঙে পড়েছে। অনেকেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র। অনেকে ঝুঁকি নিয়েই বাড়িতে আছেন। অনেকে কচুরিপানার বেড়া দিয়ে শেষ সম্বল রক্ষার চেষ্টা করছেন। বাড়ির নলকূপ ঢুবে যাওয়ায় এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। যাদের নৌকা আছে তারা পাশ্ববর্তী বাড়ি কিংবা গ্রাম থেকে পানি নিয়ে আসছে। কিন্তু যাদের নৌকা নেই তারা পড়েছে বেকায়দায়।

হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো হচ্ছে তালিমপুর ইউপি’র হাল্লা, ইসলামপুর, খুটাউরা, বাড্ডা, নুুনুয়া, পাবিজুরি, শ্রীরামপুর, মুর্শিবাদকুরা, পশ্চিম গগড়া, পূর্ব গগড়া, বড়ময়দান, গাগড়াকান্দি, তেলিমেলি,  গোপালপুর, হাউদপুর; সুজানগর ইউনিয়নের দশঘরি, রাঙ্গিনগর, ঝগড়ি, বাড্ডা, পাটনা, ভোলারকান্দি, উত্তর বাঘমারা, বাঘেরকোণা, চরকোনণা, পশ্চিম সালদিগা; বর্ণি ইউপি’র পাকশাইল, সৎপুর, কাজিরবন্দ,  নোয়াগাঁও, উজিরপুর, মুন্সিনগর এবং দাসেরবাজার ইউপি’র চানপুর, অহিরকুঞ্জি, উত্তর বাগিরপার, দক্ষিণ বাগিরপার, পানিশাইল, ধর্মদেহী, চুলারকুড়ি, কোদালী, ধলিরপাড়, নেরাকান্দি, মাইজমজুড়ি, মালিশ্রী গ্রাম। পানি কমলেও সুজানগর ইউনিয়নে ১৫টির মতো কাঁচা ও পাকা গ্রামীণ রাস্তা এখনও নিমজ্জিত। তালিমপুর ইউনিয়নে ২০টির মতো ও বর্ণি ইউনিয়নে আরও ১০টির মতো গ্রামীণ রাস্তা নিমজ্জিত আছে। একমাত্র নৌকাই পানিবন্দী মানুষের চলাচলের মাধ্যম।

সুজানগর ইউনিয়নের আজিমগঞ্জ সপ্রাবিতে আশ্রয় নেওয়া ভোলাকান্দি গ্রামের আলমাছ আলী জানান, আফালে (ঢেউয়ে) ঘর-দুয়ার ভাঙ্গি নিছেগি (নিয়ে নিছে)। বেশ কয়েক দিন ধরে এখানে আছি।

বাড্ডা গ্রামের আজিরুন বেগম জানান, ঢেউয়ে তার ঘর ও নৌকা ভেঙে গেছে। এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাননি।
এদিকে এ বছর নানা সমস্যা আর সংকট সঙ্গী হয়েছে হাওরতীরের মানুষের। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বির্পযস্ত তারা। ৩য় দফা বন্যায় এখন নতুন উপদ্রব পানিবাহিত রোগ-বালাই। বন্যাকবলিত নিন্মাঞ্চলের লোকজন পানিবাহিত নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে পানিবাহিত  রোগীর সংখ্যা। এর অন্যতম কারণ, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যানিটেশন সংকট।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: আহম্মদ হোসেন জানান, একজন উপ-সহকারি মেডিক্যাল অফিসারের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের মেডিক্যাল টিম বন্য দুর্গত ইউনিয়নে পানিবাহিত রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। কিছু ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে তবে তা নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া পর্যাপ্ত ঔষধও মজুদ রয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজাদের রহমান জানান, মন্ত্রী ওবায়দুল হকের ঘোষণার প্রেক্ষিতে ১ হাজার ৮৫০ জন ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ২৫২.৫৮ মেট্টিক টন চাল ও ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, জিআর কর্মসূচির আওতায় দুর্গতদের মধ্যে ১৫০ মেট্টিক টন চাল ও নগদ ৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। চালের পরিবর্তে মোট ১৩২৭ কেজি গম বরাদ্দ পাওয়া গেছে ভিজিএফ’র আওতায়। বরাদ্দগুলো যথাযথ নিয়মেই বিতরণ করা হয়েছে। সর্বশেষ আরও ২৫ মেট্রিক চাল ও নগদ ৪৫ হাজার টাকা ও ৬০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ মিলেছে। তবে তা এখনও বিতরণ করা হয়নি। কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণ না পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে।

সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, হাওরের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে প্রতিদিনই। সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। এছাড়া বেসরকারিভাবেও অনেকে ত্রাণ বিতরণ করছেন। লোকজনের ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি ত্রাণ সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মাধ্যমে বিতরণ হয়ে থাকে। তারা কিভাবে বিতরণ করছেন, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তারপরও বিষয়টি খোঁজ নেয়া হবে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সুন্দর জানান, পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদেরকেও বলা হয়েছে সবাই যেনো ত্রাণ পায়। তবুও কেউ কেউ অভিযোগ করছেন ত্রাণ পায়নি। বিষয়টি খোঁজ নেবো।