বিয়ানীবাজার উপজেলাটি দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দানাদার খাদ্যের মধ্যে ধান হলো প্রধান ফসল। ধান ফসলের মধ্যে রোপা আমনের আবাদ হয় সবচেয়ে বেশি। তাই এ এলাকার কৃষকদের রোপা আমনের ভালো আবাদের মাধ্যমে রচিত হয় আগামির স্বপ্ন। বৃষ্টি নির্ভর এ ফসলটি প্রায় প্রতিবারই কোনো না কোনো প্রতিকূলতার সম্মূখীণ হয়। কখনো বা আকস্মিক পাহাড়ী ঢল বা অতিবৃষ্টি খুইয়ে নিয়ে যায় বীজতলাসহ অতি যত্নে লাগানো রোপ আমনের ফসলী জমি, কখনো বা তীব্র তাপদাহে খরায় রূপ নেয় বিস্তীর্ণ ভূমি। কখনো বা রোগবালাইয়ের প্রাদূর্ভাব কেড়ে নিতে চায় কৃষকের নির্মল হাসি। কৃষকের হাসিকে অম্লান রাখতে স্থানীয় কৃষি বিভাগ তাই কাজ করে যায় নিরন্তর।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয় কৃষি বিভাগের কিছু করার থাকে যৎসামান্যই। কিন্তু রোগ বালাইয়ের দ্বারা যাতে ফসলের ক্ষতি হতে না পারে সেজন্য প্রস্তুতি নিতে হয় আট গাঁট বেঁধেই।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ধানে মোট ৩২টি রোগ শনাক্ত করেছে। তার মধ্যে ১০টি মূখ্য রোগ এবং বাকি ২২টি গৌণ। এ রোগ গুলো দ্বারা ধানের ফলন শতকরা ১০-১৫ ভাগ কম হয়। রোগ গুলোর মধ্যে ভাইরাসজনিত ২টি, ব্যাকটেরিয়াজনিত ৩টি, ছত্রাকজনিত ২২টি, কৃমিজনিত ৫টি।

ব্লাস্ট রোগ:

রোগ পরিচিতি
ব্লাস্ট ধানের একটি ছত্রাকজনিত রোগ। বাংলাদেশে এটি ধানের প্রধান রোগ। রোগটি বোরো ও আমন মৌসুমে বেশি হয়। চারা অবস্থা থেকে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যেকোন সময় দেখা যায়। রোগ প্রবণ জাতে রোগটি হলে শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত ফলন কমে যায়।

রোগ চিনার উপায়
ব্লাস্ট রোগটি ধানের পাতা, গিট, শিষের গোড়া বা শাখা প্রশাখা এবং বীজে আক্রমন করে থাকে।

পাতা ব্লাস্ট: আক্রান্ত পাতায় প্রথমে হালকা ধূসর বা নীলচে রঙের ভিজা ভিজা দাগ দেখা যায়। আস্তে আস্তে তা বড় হয়ে মাঝখানটা ধূসর বা সাদা ও কিনারা বাদামি রং ধারণ করে। দাগগুলো একটু লম্বাটে হয় এবং দেখতে অনেকটা চোখের মত। অনুকূল আবহাওয়ায় রোগটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং একাধিক দাগ মিশে গিয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত পুরো পাতা, এমনকি পুরো গাছটিই মারা যেতে পারে।

গিঁট ব্লাস্ট: গিঁট আক্রান্ত হলে আক্রান্ত স্থান কালো ও দুর্বল হয়। জোরে বাতাসের ফলে আক্রান্ত স্থান ভেঙ্গে পড়ে কিন্তু একদম আলাদা হয়ে যায় না। এ অবস্থায় আক্রান্ত গিঁটের উপরের অংশ মারা যায়।

শিষ ব্লাস্ট: শিষের গোড়া আক্রান্ত হলে সেখানে বাদামি দাগ পড়ে। শিষের গোড়া বা যেকোন শাখা অথবা ধান আক্রান্ত হতে পারে। শিষের গোড়ায় আক্রমনের ফলে সে অংশ পঁচে যায় এবং শিষ ভেঙ্গে পড়ে। ধান পুষ্ট হওয়ার আগে রোগের আক্রমনের ফলে শিষের সব ধান চিটা হয়ে যায়।

রোগটি বেশি হওয়ার অনুকূল পরিবেশ:

 হালকা মাটি যার পানি ধারণ ক্ষমতা কম
 ঠান্ডা আবহাওয়ায়
 পাতায় শিশির জমে থাকলে
 অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে
 রোগাক্রান্ত বীজ ব্যবহার করলে
 রোগপ্রবণ ধানের জাতের চাষ করলে
 জমিতে বা জমির আশেপাশে অন্যান্য পোষক গাছ বা আগাছা থাকলে।

ব্লাস্ট রোগের ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায়:

রোগ হওয়ার আগে করণীয়:

 মাটিতে জৈব সার ব্যবহার করা
 সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করা
 সুস্থ বীজ ব্যবহার করা
 আক্রান্ত ক্ষেতের খড়কুটো আগুনে পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া
 রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতের চাষ করা ( আমন মৌসুমে বিআর-৪, ৫, ১০ এবং ব্রিধান-৩২, ৩৩, ৪৪ বোরো মৌসুমে বিআর-৩, ৬, ৭, ১২, ১৪, ১৬, ১৭ ও ব্রিধান-৪৫, আউশ মৌসুমে বিআর-৩, ৬, ৭, ১২, ১৪, ১৬, ২০, ২১, ২৪)

রোগ হওয়ার পরে করণীয়:

 রোগের প্রাথমিক অবস্থায় বিঘা প্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করা
 জমিতে সব সময় পানি রাখা
 রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ট্রুপার/নেটিভো/জিল নামক ছত্রাক নাশক বিঘা প্রতি ১০৭মিঃলিঃ ১০০লিঃ পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা

(তথ্য সহায়তা- বাংলাদেশ রাইস নলেজ ব্যাংক)।

লেখক: কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস, উপজেলা কৃষি অফিসার, বিয়ানীবাজার, সিলেট।