শোষন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বারবারই সাধারণ মানুষ বিভিন্ন আন্দোলনে অধিকার ফিরিয়ে এনেছে তার প্রমাণ যুগে যুগে রয়েছে। ন্যায় আর অন্যায়ের দ্বন্দ্ব যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে, এটা সত্য দিনশেষে শত বাঁধা অতিক্রম করে ন্যায় এর জয় হয়।

১৯২২-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি সিলেটের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চালায়। এতে বিয়ানীবাজার, বড়লেখা, কুলাউড়া, বালাগঞ্জ ও ধর্ম পাশা উপজেলার অনেকেই এই বিদ্রোহের প্রাণ ছিলো। তার মধ্যে সুখাইড় বিদ্রোহ, রফিনগর বিদ্রোহ,বাহাদুরপুর বিদ্রোহ(১৯৩৮-৩৯) অন্যতম।১৯৪৬ সালে একই সাথে গড়ে উঠেছিল বটরশি,কোনা শালেশ্বর,মহাকল বিদ্রোহ। এই সব বিদ্রোহ নানান জায়গায় বিভিন্ন নামে হলেও এটা ছিলো মূলত নানকার বিদ্রোহ।

নান শব্দের অর্থ হচ্ছে রুটি। রুটির বিনিময়ে যারা কাজ করতো এদেরকে নানকার বলা হতো। ১৯৪৯ এর পহেলা ভাদ্র তৎকালীন সরকারের পুলিশ বাহিনী ও তাদের নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী সানেশ্বর ও উলুউরী গ্রামের নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা চালায়। মূলত দাসপ্রথাটা পরবর্তীতে রূপ পায় নানকার প্রথায়।

নানকাররা জমিদারের অল্প পরিমাণ জমিতে বিভিন্ন শর্তে রাজি হয়ে ফসল ফলানো এবং বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতো। কিন্তু কখনো এই জমির মালিকানা দাবী করতে পারতোনা। ইচ্ছে হলেই নানা ধরনের নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের উচ্ছেদ করে দিতো।তাদেরকে জমিদার ডাক দিলেই কাজ করে দিতে হতো।একটু ব্যত্যয় ঘটলে চলতো অমানবিক নির্যাতন।অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এটা যে, পুরুষদের কাজ করিয়ে তারা থামেনি। তারা নানকার মহিলাদের ভোগ্যপন্য হিসেবেও ব্যবহার করতো। নানকাররা জমিদারদের বাড়ি অতিক্রম করার সময় জুতা পায়ে দেওয়া এবং ছাতা টাঙাতে পারতো না। যদি ভুলক্রমে কেউ কথা অমান্য করতো তাহলে তার জীবনে কঠিন দুর্দিন নেমে আসতো।

এই নির্যাতনের মাত্রা এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল, বাধ্য হয়ে নানকাররা পালটা জবাব দেওয়ার কৌশল খুজতে শুরু করে। নানকার স্মৃতি বিজরিত একটু দূরে বাহাদুরপুরের জমিদার মথুরা ধোপীকে সামান্য ভুলে জুতা পেটা করলে জমিদারকেও সে পরবর্তীতে নাকে, মুখে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জুতা দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করে দেয়।

১৯৪৬ সালে কমরেড অজয় ভট্টাচার্য সঠিক নেতৃত্ব দিলে সকল নানকারদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে ওঠে।প্রতিদিনই বর্তমান নানকার স্মৃতি সৌধ এলাকার যুবকদের বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে এই খবর পার্শ্ববর্তী এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। এজন্য তৎকালীন পাকিস্তানি শাষক গোষ্ঠী বিদ্রোহ নস্যাৎ করতে সাম্প্রদায়িক হামলা লাগানোর চেষ্টা করে এবং নানকারদের আরো কঠিনতম নির্যাতন শুরু করে। এভাবে কেটে নানান দাঙা হাঙ্গামায় চলে যায় ১৯৪৯ এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত। ১৯৪৯ এর মে মাসে জমিদারের লোকেরা নির্মমভাবে হত্যা করে শহীদ রজনী কান্ত দাসকে। তারা রজনী কান্তের মামলায় আন্দোলনের সম্পৃক্ত কৃষক নেতাদের গ্রেফতার করে নিয়ে নেতাদের নিয়ে যায় এবং এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক যড়যন্ত্র আরও বেগবান করে।

স্থানীয় সানেশ্বর বাজারে আন্দোলনের নেতারা এই সালের ১৪ ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করে। কিন্তু জমিদাররা ফায়দা নেয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের কাছে নালিশ করে যে, হিন্দুরা ১৫ ই আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালন করছে। এই অপপ্রচারের খবর পেয়ে পাকিস্তান সরকার পুলিশ ও ইপিআরদের বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেয়। তাদেরকে মূলত নির্দেশ দেওয়া হয় আন্দোলনকারীদের নির্মুল করে দেওয়ার।

বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার আনুমানিক এক মাস পূর্বে সানেশ্বর গ্রামের রজনী কান্ত দাস পার্শবর্তী গ্রাম মিহারীতে আত্বীয়ের বাসায় বেড়াতে যান। ফিরে আসার সময় স্থানীয় সানেশ্বর বাজার খেয়া ঘাট সংলগ্ন এলাকায় জমিদারের পেটুয়া বাহিনীর সাথে সাক্ষাত হয়। তারা ধরে নেয় যে রজনী কান্ত দাস জমিদারের বিরুদ্ধে সামবেশ থেকে আসছেন। তাদের ভয়ে তিনি সাতাঁর দিয়ে নদী পেরুনোর চেষ্টা করলে জমিদার বাহিনী তার উপর আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করে।

১৮ই আগষ্ট দিনের প্রথম প্রহর ঠিক এই সময়ে যখন নানকাররা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলো। তখন তাদেরকে লাথি মেরে, রাইফেল দিয়ে আঘাত করতে থাকে। ততক্ষণে এই খবর পার্শ্ববর্তী এলাকায় জানাজানি হয়ে গেলে সবাই লাঠিসোটা নিয়ে একত্রিত হতে থাকে। এই ফাঁকে পেটোয়া বাহিনী ঘরে ঢুকে মালামাল লুট করতে থাকে। কেউ বাধা দিতে আসলে শারীরিক নির্যাতন করে। এ থেকে রেহাই পায়নি অবুঝ শিশুরাও।

উলুউরী ও সানেশ্বর গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে সবাই মুখোমুখি হলে সশস্ত্র বাহিনী নানকারদের আত্মসমর্পণ করতে বলে।
তখন উত্তপ্ত জনতা সশস্ত্র বাহিনীকে বন্দুক ফেলে দিতে বলে।কথাটা শেষ হতেই আক্রমণ চালায় পুলিশ বাহিনী। গুলির শব্দে অনেকেই ছিটকে পড়েন। প্রতিশোধ নিতে ব্রজনাথ দাস, চটই দাস এগিয়ে যান পুলিশের সামনে। কিন্তু ততক্ষনে পুলিশের গুলি তার এক কানে ঢুকে কান ঝাজরা করে দিয়ে আরেক কানে বের হয়।সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন চটই। একে একে এই যুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার আশায়, দেশকে স্বাধীন করার মানসে জীবন দেন ব্রজনাথ দাস,কুটুমনি দাস,প্রসন্ন কুমার দাস। আপন দুই ভাইদের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হোন পবিত্র দাস আর বন্দী অবস্থায় শহীদ হন অমুল্য কুমার দাস। আহত হয়েছিলেন দীননাথ দাস, অদ্বৈত চরণ দাস, হৃদয় রাম দাস। শহীদ রজনী কান্ত দাস সহ মোট ছয়জনের জীবনের বিনিময়ে দাসত্বপ্রথা বিলুপ্ত ঘটে।

এই আন্দোলনে জীবন বাজী রেখে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জমিদার পরিবারের সন্তান সুরথ পাল চৌধুরী ও তার স্ত্রী অপর্ণা পাল চৌধুরী। ঐ দিনে অত্যাচারীদের নির্যাতনে অপর্ণা পাল চৌধুরীর গর্ভপাত হয়েছিল। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন তিনি কারাবন্দী ছিলেন। তাঁকে ছাড়াও বন্দী করে নিয়ে যায় প্রল্লাদ,হিরন্য বালা,প্রকাশ দাস,অসিতা পাল চৌধুরী সহ আরও অনেককে। এই দিন থেকে গণগ্রেফতার বাড়তে থাকে।মৃতদেহ সৎকার করতে পারেনি স্বজনরা, এমনকি দেখতেও পারেনি।

অবশেষে আন্দোলনের তীব্র গতির ফলে ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। মুক্ত করে দেয় কৃষকদের। কৃষকেরা মালিকানার স্বীকৃতি পায়।

এ ঘটনা মানুষ ভুললেও, ইতিহাস কখনো ভুলবে না।ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবী আদায় করা হয়। এভাবেই ১৯৭১ সালে এই দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, মাত্র একদিন পুস্পস্তবক অর্পণ করে শেষ নয়। বর্তমান প্রজন্মকে জানানো উচিৎ, আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের কথা। এজন্য, পাঠ্য বইয়ের পাতায় সংযুক্ত করা হোক। এটা নিয়ে গবেষণার সুযোগ করে দেওয়া হোক। তবেই আমাদের এই প্রজন্ম নানকার বিদ্রোহ সম্পর্কে ভালো করে জানবে।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, সানেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।