সারাদেশে ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে’ এমন একটি গুজব ছড়ানোর পর থেকে বিয়ানীবাজার উপজেলাও ছড়িয়ে পড়েছে ‘কল্লাকাটা’ আতঙ্ক। ‘’স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে স্প্রে দিয়ে অজ্ঞান করে ছোট্ট শিশুটিকে তুলে নিয়ে গেছে’’, ‘’স্কুল থেকে ফেরার পথে হারিয়ে গেছে অন্য একটি শিশু’’, ”রাস্তায় কালো গাড়িতে করে ছেলেধরা (কুছুধরা) চক্র ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছে”, ”অপরিচিত এক আগুন্তুকের ব্যাগে ছোট্ট বাচ্চার ‘কাঁটা মাথা’ পাওয়া গেছে” ‘‘পাশের এলাকা কিংবা পাশের উপজেলায় এক শিশুতে ধরে নিয়ে গেছে” – সম্প্রতি এমন অসংখ্য মিথ্যা ও বানোয়াট গল্প ভাসছে বাতাসে। সেই গল্পগুলো অভিভাবকদের মনে অজানা আতঙ্ক তৈরি করছে। সাজানো এ গল্প সত্যি মনে করে অভিভাবকরা আতংকে রয়েছেন। নাড়ি ছেড়া ধনকে চোখের সামনের রাখতে অনেকেই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

মূলত নেত্রকোনায় এক মাদকাসক্তের কাছে একটি শিশুর ‘কাটা মাথা’ পাওয়ার পর আতঙ্কের মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতেও ভয় পাচ্ছেন অনেক অভিভাবক। তাদের আতঙ্ককে বাড়িয়ে দিতে প্রতিদিনই নতুন নতুন বানোয়াট গল্প তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অনুসন্ধানে কোনো গল্পেরই সত্যতা মেলেনি। পুলিশও বলছে ‘স্রেফ গুজব’, ‘কল্লাকাটা’ বা ‘কুছুধরা’ বলতে কিছু নেই। তবে কেউ যাতে গুজবের সুযোগ নিয়ে কোনো অপরাধ করতে না পারে সে ব্যাপারে পুলিশ যেমন সতর্ক রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির ও বিভিন্ন হাটবাজারে গুজবে কান না দিতে সচেতনতামূলক মতবিনিময় ও প্রচারণা চালাচ্ছে বিয়ানীবাজার থানা পুলিশ। একই সাথে সন্দেহের বশে কাউকে মারধর না করে পুলিশের কাছে সোর্পদ করার আহবান জানানো হয়েছে।

শিশু অপহরণের গুজবটি প্রথম ছড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হাত ধরে। গুজব ছড়ানো হয় যে, পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে এক লাখ মানুষের মাথা নদীতে উৎসর্গ করতে হবে। গুজব প্রচারকারীরা আতঙ্ক ছড়াতে থাকে যে, মাথার খোঁজে- বিশেষ করে শিশুদের মাথা কেটে আনতে ৪২টি দল দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেমে পড়েছে। ভিত্তিহীন ও আজগুবি এসব তথ্যের সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই অনেকেই তা শেয়ার করতে থাকেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর তাতেই আতঙ্ক আরো বেশি করে দেখা দেয় সাধারণে মাঝে। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে যে, সরকারকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছে এই ধরনের প্রচারের কোনো ভিত্তি নেই। গুজব যারা ছড়াচ্ছে ইতোমধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। কিন্তু এরপরও সাধারণ মানুষ গুজবের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। সন্দেহের দোলাচলে দোলছেন তারা। এরই মাঝে বুধবার নেত্রকোণায় এক মাদকাসক্তের ব্যাগ থেকে একটি শিশুর খন্ডিত মস্তক উদ্ধারের ঘটনায় আতঙ্ক নতুন মাত্রা পায়। অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন ‘কল্লাকাটা’র অস্তিত্ব। কাউকে সন্দেহ হলেই ধরে গণপিটুনি দিচ্ছেন তারা।

গত ১৯ জুলাই রাতে পার্শ্ববর্তী বড়লেখা উপজেলার দৌলতপুর বাজারে ছেলেধরা সন্দেহে দুই যুবককে আটক করে গণধোলাই দেয় উত্তেজিত জনতা। পরে পুলিশ তাদের ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, গণধোলাইয়ের শিকার দুই যুবক মাদকাসক্ত। শাহবাজপুর বাগান থেকে ফেরার পথে পূর্ব বিরোধের জের ধরে তাদের উপর কুছুধরা অপবাদ দিয়ে হামলা চালায় প্রতিপক্ষরা। বাজার এলাকা হওয়ায় গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছিল তাদেরকে। গত ২৪ জুলাই দুপুরে পৌরশহরের পণ্ডিতপাড়া এলাকায় সাহায্যের জন্য আসা এক মহিলাকে স্থানীয়দের ছেলেধরা সন্দেহে জেরার মুখে পড়তে হয়। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।

এদিকে গত বুধবার রাতে উপজেলা উত্তরবাকাখাজানা এলাকার ছরফর আলীর পুত্র আফজল হোসেনকে কুছুধরা স্প্রে করে সিএনজিতে তুলে নিয়ে যায়। আফজল জ্ঞান ফিরলে দেখে একটি কালো রঙের নোহা গাড়ির পেছনের সিটে শুয়ে আছে। তার পাশে আরো তিনটি শিশু। সে গাড়ির পেছনের গ্যাস সিলিন্ডারের পাশে রাখা দা দিয়ে ৪ কুছুধরার উপর হামলা চালালে তারা তাকে জকিগঞ্জের শাহগলি এলাকায় ফেলে যায়। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় শাহগলি ফুফুর বাড়িতে আশ্রয় নেয় আফজল হোসেন। তার বা হাতে ধারালো অস্ত্রের কোপ রয়েছে। এ ঘটনা রহস্যজনক জানিয়েছেন বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবনী শংকর কর। তিনি বলেন, ঘটনার দিন রাতে খবর পেয়ে উত্তর আকাখাজানা গিয়ে আফজলের কথা শোনে ঘটনাটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন। তিনি বলেন, আমরা তদন্ত করছি। প্রকৃত ঘটনা কি সেটি বেরিয়ে আসবে। আমাদের ধারণা- তার উপর হামলার অন্য কোন ঘটনার জেরে হয়েছে।

গণপিটুনি ঘটনার প্রেক্ষিতে এ ধরণের ঘটনাকে বড় অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে গণপিটুনি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে বিয়ানীবাজার থানা পুলিশ। শনিবার বিকেলে পৌরশহরের এ নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাপক প্রচারনা চালিয়েছে থানা পুলিশ।  পুলিশ জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণে মাথা লাগবে- একটি মহল এমন গুজব ছড়ানোর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। প্রচারণাকালে থানা পুলিশ আরও জানায়, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি একটি ফৌজদারি অপরাধ। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। গণপিটুনির ঘটনা তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।

এদিকে, শিশু অপহরণ আতঙ্কে উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার আগের চেয়ে কমে গেছে। অনেক অভিভাবক ভয়ে সন্তানদের স্কুলেও পাঠাচ্ছেন না। উপজেলার মাথিউরা এলাকার বাসিন্দা হাসান জানান, ছেলেধরা আতঙ্কে তিনি তার দুই মেয়েকে মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন না। তিনি বলেন, আসলেই ছেলেধরা চক্র বিয়ানীবাজারে আছে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরও কেউ দিতে পারছে না।

গোলাপগঞ্জের ভাদেশ্বর (করগাও) এলাকার রানা এ প্রতিবেদকের কাছে মোবাইলে কল দিয়ে জানতে চান বিয়ানীবাজারে কোন শিশুর মাথা বিহীন লাশ পাওয়া গেছে কি না। সেরকম কোন ঘটনা বিয়ানীবাজারে ঘটেনি জানানোর পর তিনি বলেন, তাদের এলাকায় বিয়ানীবাজারে মাথা বিহীন একটি শিশুর লাশ পাওয়ার খবর লোকমুখে রয়েছে।

বিয়ানীবাজার জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আহমেদ ফয়সাল বলেন, আমার ধারণা দেশবিরোধী একটি চক্র দেশের শান্তি বিনষ্ট করতে এধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। এটি দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ। সাংবাদিক আহমেদ ফয়সাল এ ধরনের গুজবে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত না হওয়ার আহবান জানান ।

ছেলেধরা বলেন আর কুছুধরা বলেন এটি গুজব- আমাদের সবাইকে সচেতন হয়ে এ গুজবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে এ আহবান জানিয়ে বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবনী শংকর কর বলেন, ছেলেধরার বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব। একটি মহল মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করতে এমন বানোয়াট ও মিথ্যা গল্প ছড়াচ্ছে।তিনি বলেন, বিয়ানীবাজার কিংবা আশপাশ এলাকায় যারা আক্রান্ত হয়েছে এর পেছনে পূর্বের কোন না কোন বিরোধ ছিল। আমরা বিষয়টি খুব কঠোর হস্তে দমন করবো। এতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।