শৈশব থেকেই রুহুল আমিন ফাত্তাহ স্যারকে চিনি ও জানি। তিনি ‘ফাত্তাহ মাস্টার’ হিসাবে সর্ব মহলে এক নামে পরিচিত। তাঁর বাড়ি যেমন মাথিউরার তেমনি বিয়ানীবাজার পৌরসভার দামগ্রামে। দাসগ্রামেই পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছেন।

মাথিউরা ঈদগাবাজারের পাশে আমাদের বাড়ি। স্যারদে পৈত্রিক বাড়ি বাজারের সন্নিকটে। সেই সুবাদে ছোলবেলা থেকে স্যারকে চিনতাম। বাজার কেন্দ্রীক গ্রামের বড় কোন সালিশ বসলেই সেখানে ফাত্তাহ স্যারের উপস্থিত ঘটানো দু’পক্ষের দায়িত্বের মধ্যে পড়তো। মাথিউরাসহ উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক বৃটেন বা মার্কিন মুল্লকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়া ব্যক্তিদের সেই দেশে গমনের ক্ষেত্রে ফাত্তাহ স্যারের যতেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

দূতাবাস থেকে আসা কাগজ-পত্র তৈরি, কারো সত্যতা যাছাইয়ের জন্য দূতাবাস থেকে আসা প্রতিনিধিতের সাথে দুভাষীর ভূমিকা এবং সবকিছু বুঝিয়ে দেয়ার মহান দায়িত্ব পালন করতেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ফাত্তাহ স্যার। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রবাস গমনকারিদের আর্থিক মধ্যস্থতায় ফাত্তাহ স্যারের বূমিকা ছিল অতুলণীয়।

১৯৯৯ সালে আমি যখন মাথিউরা দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই স্যারের ম্যাধমে। সে সময় অষ্টম শ্রেণীতে মাত্র তিনজন মাথিউরার ছাত্র ছিলাম। ফাত্তাহ স্যারের ছেলে হাসান, দুধবকসীর দুদু স্যারের ছেলে বুলবুল ও আমি। স্যার আমাদের বিজ্ঞান পড়াতেন। তবে কেন জানি আমাকে বেশি স্নেহ করতেন। এক সময় হাসানের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। আমি দাসগ্রামে বিরাজ স্যারের কাছে ইংলিশ ও তিমির স্যারের কাছে গনিত পড়তাম। প্রাইভেট পড়া শেষে স্যারের বাড়ির সামনের রাস্থাদিয়ে আব্দুল সালাম রোড হয়ে স্কুলে যেতাম। বহুদিন এরকম হয়েছে- স্যার দেখেছেন আমি স্কুলে যাচ্ছি হাসান বা রেদওয়ান ( স্যারের ২য় ছেলে) দিয়ে ডাকলেন বাসায় যেতে বলতেন। দাড়াও ভাত খেয়ে হাসানের সাথে স্কুলে যাবে। আমি নিচু স্বরে বলতাম,
-জ্বী না স্যার ভাত খাবো না।
তখন ধমক দিয়ে মায়ামাখা কন্ঠে বলতেন
-সাত সকালে এসেছিস প্রাইভেটে, বাড়ি ফিরবি সন্ধ্যায়। স্কুল শেষ করে তো বাড়ি যাসনা। কলেজ মাঠে অন্যদের মেতে উঠিছ।
আমার আর কিছু বলতাম না। মুর্শেদা আপাকে (স্যারের বড় মেয়ে, বর্তমানে আমেরিকায় বাস করেন) ডেকে বলতেন আমাদের খাবার রেডি করতে। কোনদিন স্যারের বাসায় দেরি হয়ে গেলে স্যারের সাথে স্কুলে যেতাম। আমাদের ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে স্যার অফিস কক্ষে যেতেন। এ রকম অসংখ্য দিন স্যারের নিংস্বার্থ আদর ও ভালোবাসা পেয়েছি।

খুব মনেপড়ে ২০০২ সালের কথা। আমার প্রথম সম্পাদনা সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘সূর্যসেনা’ স্যারের হাতে দিলাম। বিস্ময়কর চেহারায় তাকিয়ে বলছিলেন
-বাবা এ সব করছো ভালো কথা, কিন্তু এসবে রুটি রোজকার হবে না। মনদিয়ে লেখাপড়া করো’।
পরের বছর যখন ২য় সংখ্যা বের করলাম দেড়মাস হয়ে গেছে স্যারকে দেওয়া হয়নি। খুব সম্ভবত নিউ মার্কেট ময়নুল ভাইয়ের দোকানে দেখেছেন সূর্যসেনা’র ২য় সংখ্যা। একদিন কলেজ রোডে পেয়ে আমায় বললেন
-শুক্রবার সকালে তোমার ম্যাগাজিন নিয়ে বাড়িতে আসিস’। আমি ত মেরে গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর কাছে বসিয়ে বললেন-
ম্যাগাজিন বিষয়ে তোমার নিরুৎসাহিত করনি, তবে বাস্তবতার হলো এ অঙ্গনে সম্মান পাবে। কিন্ত জীবন চালাতে হিমশিম পেয়াতে হবে। লেখা-পড়া শেষ করে চাকরি বা ব্যবসায় হাত দাও’। জু’আর নামাজের পড়ে স্যারের সাথে খাওয়া-দাওয়া সেরে চলে আসি।

ফার্ণিচার ব্যবসা শুরু করবো। চিন্তা করলাম বিয়ানীবাজারের দু’এক জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পরার্মশ নেই। এক সন্ধ্যায় ময়নুল ভাইয়ের ভ্যারাইটিজ ফার্নিচারে গেলাম। সেখানে ছিলেন মস্তকিন আলী (সাবেক চেয়ারম্যান), আলীম উদ্দিন ( সাবেক চেয়ারম্যান), রুহুল আমিন ফাত্তাহ স্যার ও পাতনের একজন শিক্ষক। আমাকে দেখে ময়নুল ভাই জিজ্ঞাস করলেন কোন কাজে কি না? দাড়িয়ে রয়েছি, কিছু বলছি না। স্যার বিষয়টি লক্ষ্য করে ময়নুল ভাইকে বললেন
-আপনি একটু ভেতরে যান। স্বপন হয়তো কোন কাজে এসেছে’।

কাজ সেরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। পরে ময়নুল ভাইয়ের কাছ থেকে শুনলাম তিনি আমার ব্যবসার কথা হাউজে বলতেই স্যার বলেছিলেন-‘সে পারবে’।

গেলো বছর মাথিউরা দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠান হয়েছি। সে আয়োজনে রুহুল আমিন ফাত্তাহ স্যার ও তিমির পাল চৌধুরী স্যারসহ অন্যান্যরা সংবর্ধিত অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে তিমির স্যার ও ফাত্তাহ স্যারকে বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্ব ছিল আমার। কারযোগে স্যারেদের বাড়ি পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে রওয়ান দেই। রাস্তায় আমি দৈনিক যুগান্তরে কাজ করি শুনে স্যাররা অনেক খুশি হয়েছিলেন।

ফাত্তাহ স্যার তিমির স্যারকে বলেছিলেন
-স্বপন থেমে থাকেনি, চতুর্দিকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিনও স্যারের বাসায় তিমির স্যার ও আমি অনেক সময় অবস্থা করেছিলাম। গত জানুয়ারির ১৮ তারিখ স্যারের বাসায় শেষ যাওয়া আমার শুভ পরিণয়ের নিমন্ত্রণ নিয়ে। স্যার বলেছিলেন
– বাবা আমি পঁচিশ তারিখে ঢাকা চলে যাবো জরুরী কাজে। তোমাদের জন্য শুভকামনা।

বেশ কয়েকদিন থেকে চেষ্টা করছি তাহমিনা (সহধর্মিনী) কে নিয়ে তিমির স্যার ও ফাত্তাহ স্যারের সানিধ্যে গিয়ে আর্শিবাদ নেব। নিজের খামখেয়ালী ও সময় সুযোগের অভাবে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। প্রিয় ফাত্তাহ স্যার আজ না ফেরার দেশে। স্যার চির বিদায় নিলেও হাজার হাজার শিক্ষার্থী, অভিবাবক ও সুধীজনের মণিকোটায় চিরদিন জাগ্রত থাকবেন। স্যার ওপারে ভাল থাকুন।