বিয়ানীবাজার উপজেলার জলঢুপ গ্রামে উৎপাদিত কমলার খ্যাতি দেশজুড়ে। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ছোট-বড় কমলার বাগান। এ গ্রামের উৎপাদিত কমলা ‘জলঢুপের কমলা’ নামেই পরিচিত। ভিন্ন স্বাদের কারণেই গত কয়েক বছরের ব্যবধানে ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় জলঢুপের কমলা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা হতো বিভিন্ন দেশেও। তবে এখন আর আগের সুসময় নেই। ধারাবাহিকভাবে কমছে কমলা চাষ। অব্যাহত লোকসানের কারণে বেশির ভাগ চাষীই কমলা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এতে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে জলঢুপের কমলা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশিক্ষণের অভাব, গাছ ও মাটির পরিচর্যা না করার কারণে বিয়ানীবাজারসহ সিলেটে কমলা উৎপাদন কমছে। কৃষকদের প্রশিক্ষিত করাসহ কমলা চাষ বাড়াতে একটি প্রকল্পের কাজ চলছে।

বিয়ানীবাজারের মাথিউরা এলাকার প্রবীণ আব্দুল শুকুর। স্কুল শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন অনেক আগেই। তিনি বলেন, আমাদের নিজেদের বাগান নেই। কিন্তু আগে আমাদের কখনই কমলা কিনে খেতে হয়নি। আশপাশের বাগান মালিকরা প্রতি বছর বিনা মূল্যে অনেক কমলা দিয়ে যেতেন। চাইলেও বাগান থেকে কমলা পেড়ে আনা যেত। টাকা দিতে হতো না। অথচ এখন টাকা দিয়েও বাজারে স্থানীয় জাতের কমলা পাওয়া যায় না।

বিয়ানীবাজার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনিছুজ্জামান বলেন, বিয়ানীবাজারের কমলা বাগানগুলোয় পরিচর্যার অভাব রয়েছে। তাছাড়া মাটি উর্বরতা হারালে এবং ফুল ফোটার সময় বেশি গরম থাকলে ফুল ও ফল ঝরে যেতে পারে।

তিনি বলেন, বিয়ানীবাজারের কমলা বাগানগুলোর বেশির ভাগ মালিক প্রবাসে অবস্থান করেন। ফলে সঠিক পরিচর্যা হয় না। সেজন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলনও হয় না। তবে আমরা সব সময়ই চাষীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, সিলেটের গোয়াইনঘাট, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় কমলার চাষ হয়। পুরো জেলায় প্রায় ৩০০ কমলার বাগান রয়েছে। প্রায় ৬০০ হেক্টর জমিতে কমলা চাষ হয়। এর মধ্যে বিয়ানীবাজারে মোট ১৫০টি কমলা বাগানে ৫০ দশমিক ৫২ হেক্টর জমিতে কমলা চাষ হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জলঢুপ এলাকার কমলা আগেভাগেই পরিপক্ব হয়ে ওঠে। মৌসুমের শুরুতে বাজারে যে দেশী প্রজাতির কমলা পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই জলঢুপসহ আশপাশের এলাকার কমলা। তবে এবার এ উপজেলায় কমলার উৎপাদন একেবারেই কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।

বিয়ানীবাজারের বিভিন্ন কমলা বাগান ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ বাগানই এবার প্রায় কমলাশূন্য। কৃষকরা জানান, এবার পরিপক্ব হওয়ার আগেই কমলা গাছ থেকে ঝরে পড়েছে।

উপজেলার পাড়িয়াবহরের কমলাচাষী হামিদ আহমদ বলেন, আমার দুটি বাগানে এবার কমলা চাষ করেছিলাম। কিন্তু এবার উৎপাদন খুব কম। দুই বাগান মিলিয়েও ২০ হাজার টাকার কমলা বিক্রি করতে পারব না। অথচ গত বছরও ৫০-৬০ হাজার টাকার কমলা বিক্রি করেছি।

উপজেলার গলাসাঙ্গন গ্রামের কমলাচাষী ইব্রাহিম আলী বলেন, কয়েক বছর ধরেই কমলা চাষ করে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। গাছে কমলার ফলন আসার পর তা পরিপক্ব হওয়ার আগেই পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। ফলে পাকার আগেই কমলা গাছ থেকে ঝরে পড়ে। আর এবার তো উৎপাদন খুবই কম হয়েছে। এখন কমলা চাষ করে লাভের পরিবর্তে লোকসান হচ্ছে বেশি। লোকসানের কারণে এখন অনেকেই কমলা চাষ ছেড়ে দিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রটি জানায়, সিলেট অঞ্চলে কমলা চাষ বাড়াতে ২০০১ সালে ‘বৃহত্তর সিলেট সমন্বিত কমলা চাষ উন্নয়ন’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। আট বছরের ওই প্রকল্প শেষে এ অঞ্চলে কমলার চাষ বেড়ে যায় দ্বিগুণ। তবে এরপর বন্ধ হয়ে যায় কমলা চাষ বৃদ্ধির উদ্যোগ। এতে আবার কমতে শুরু করে কমলা চাষ। প্রায় ১১ বছর পর ২০১৯ সালের শেষ দিকে ‘লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প’ নামে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে সিলেট ও মৌলভীবাজারের নয় উপজেলায় কমলার উৎপাদন বাড়াতে কাজ করা হবে। ২০২৩ সালব্যাপী এ প্রকল্পের সুফল এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।

তারা জানান, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, বৈরী আবহাওয়া, পাহাড়ি জমি হ্রাস পাওয়ার কারণে কমছে সিলেটে কমলার উৎপাদন। ফলে চীন, ভারত, ভুটান নেপালসহ বিদেশী কমলা দখল করে নেয় দেশের বাজার।

জলঢুপ এলাকার কমলাচাষী নিটোল ভট্টাচার্য বলেন, জলঢুপসহ আশপাশের এলাকায় কমলা উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এখানকার কমলা খুবই মিষ্টি। তাই বাজারে এর চাহিদাও রয়েছে। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতা ও কৃষকদের আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আগের মতো গাছ ফেলে রাখলেই বছর বছর ফল ধরবে না। এখন গাছ ও মাটির যত্ন নিতে হবে। পরিচর্যা করতে হবে। এখানকার কৃষকরা এসব ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, এখানকার কৃষকরা কমলা চাষের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়। এছাড়া তাদের প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, বিশ্বনাথ, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও বিয়ানীবাজার এবং মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি বড়লেখা, শ্রীমঙ্গল ও কুলাউড়া এ নয় উপজেলায় প্রকল্পটির কাজ চলছে।

তিনি বলেন, কমলা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, কমলার নতুন বাগান সৃষ্টি, পুরনো বাগান ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৫-২০ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্প শেষ হলে সিলেটের কমলার হারানো সুদিন অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র- বণিক বার্তা।