৭ জুন বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক দিক নির্দেশক দিন। বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা আন্দোলন এর সঙ্গে ৭ জুনের ঘটনা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে। এ আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল জাতির স্বাধীনতার বীজ।

গণতন্ত্রের মানসপুত্র মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রবাসে হোটেল কক্ষে রহস্যজনক মৃত্যুতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন এ ফ্রন্টের প্রাণপুরুষ। এ সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ফ্রন্টের প্রধান শরীক আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। বঙ্গবন্ধুর এ সিদ্ধান্ত জাতিকে তার স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তানে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পাকিস্তানের উভয় অংশের প্রায় ৭৪০ জন জনপ্রতিনিধি অংশ নেন। পূর্ব বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু সহ ২৫ জন নেতা সম্মেলনে যোগ দেন। এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাঙালী মুক্তির সনদ ঐতিহাসিকস ৬ দফা কর্মসূচী উপস্থাপন করেন।

ঐতিহাসিক ৬ দফা হচ্ছে-

প্রস্তাব-১ : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি

দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে ফেডারেশন ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি লাহোর প্রস্তাব। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।

প্রস্তাব- ২ : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা

কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে যথা- দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।

প্রস্তাব- ৩ : মুদ্রা ও অর্থ সম্বন্ধীয় ক্ষমতা

মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে :

(ক) সমগ্র দেশের জন্য দুইটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্য কেবলমাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসু ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাঙ্কিং রিজার্ভের পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক ও অর্থ বিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।

প্রস্তাব- ৪ : রাজস্ব, কর ও শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা

ফেডারেশনের অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির সব রকম করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।

প্রস্তাব- ৫ : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা

(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বর্হিবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বর্হিবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির একতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মেটাবে।
(ঘ) অঙ্গরাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রবাদির চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোন বাধা-নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্বস্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

প্রস্তাব- ৬ : আঞ্চলিক বাহিনীর গঠন ক্ষমতা

আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা-সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

৬ দফার মর্মবাণী বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ঝটিকা সফরে বের হন। বঙ্গবন্ধুকে কারারুদ্ধ করা হয়। শুরু হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে ধড়পাকড়। জেলের বাইরে অবস্থিত আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সভা করে অহেতুক গ্রেফতার ও জেল জুলুমের প্রতিবাদে দেশ ব্যাপী হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। সরকার চ- নীতি গ্রহণ করে। সংবাদপত্রে হরতালের খবর প্রকাশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে। ৫ জুন ঢাকা শহরে সমস্ত মিল এলাকা এবং দেশের বিভিন্ন শহরে পুলিশ ও ইপিআর মোতায়েন করা হয়। ৬ জুন সন্ধ্যায় হরতালের সমর্থনে ঢাকা শহরে ছাত্রলীগ বিরাট মিছিল বের করে। সরকার যেকোন মূল্যে হরতাল বানচালের জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়। অপর দিকে বাংলার উত্তাল মানুষ জীবন বাজি রেখে হরতাল সফল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।

৭ জুন বাঙালী জাতির ইতিহাসে খুনে রাঙা একটি দিন। অগ্নিগর্ভ এ দিন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। এ দিনের সঙ্গে শহীদ মনু মিয়ার নাম অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। স্বাধিকার আন্দোলনের দিক নির্দেশক এ দিন মনু মিয়া শহীদ হন। এ দিন সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে হরতাল শুরু হয়। শিল্পাঞ্চলে কলের চাকা ঘুরেনি। অফিস আদালতের তালা খুলেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ।

সরকারী হিসেব মতে হরতালের সময় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ১১ জন নিহত হয়। নিহতের আসল সংখ্যা ছিল এর চেয়ে অনেক বেশী। তেজগাঁও এ পুলিশের গুলিতে মনু মিয়া সহ অনেকে শহীদ হন। শ্রমিক নিহতের সংবাদ দাবানলের মতো চারেিক ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা মহানগর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের খ- খ- সংঘর্ষ হয়। অবস্থার আরোও অবনতি ঘটতে থাকলে দুপুরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সন্ধ্যায় শোক মিছিলের উপর পুলিশ আবার গুলি চালায়।

৭ জুন প্রথম গুলি বর্ষিত হয় তেজগাঁও আউটার সিগনালের কাছে। এখানে শহীদ হন সেভেন আপ কোম্পানীর ভ্যান চালক শ্রমিক নেতা মনু মিয়া সহ আরোও অনেকে। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন নুরে আলম সিদ্দিকী। এ দিনের স্মৃতিচারণ করতে যেতে তিনি বলেন, মাইল পোস্টের উপর দাঁড়িয়ে বললাম, “ভাই সব আপনারা লাইন রেল লাইন) উপড়ে ফেলবেন না। আসুন আমরা লাইনের উপর শুয়ে পড়ি। ওদের (পুলিশ) সাহস থাকলে গাড়ী চালাবে। …হঠাৎ কম্পার্টমেন্ট থেকে হাত বাড়িয়ে রিভলবার দিয়ে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মনু মিয়া মাটিতে পড়ে গেল। তাঁর ডান পাঁজরে গুলি লেগেছিল। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখনকার মানসিক অবস্থা বর্ণনাতীত। মাইল পোস্ট থেকে নেমে আর ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরা জায়গাটা চেপে ধরলাম। মনু মিয়া যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, তার কণ্ঠ বিকৃত। তবু সে বলল, ‘আমাকে ধরা লাগবে না। আপনি কইয়া যান।’ আমি আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে বললাম কি বলব? আজো সেই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি কানে বাজে। সে বলেছিল, সংগ্রামের কথা বলেন …। (৭ জুনের স্মৃতিচারণ : নুরে আলম সিদ্দিকী, দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ জুন ১৯৭০)

মনু মিয়ার বাড়ী বিয়ানীবাজারের বড়দেশ গ্রামে। পুরো নাম ফখরুল মৌলা খান ওরফে মনু মিয়া। পিতার নাম মনোহর আলী। মনু মিয়া ছিলেন পিতা-মাতার দ্বিতীয় পুত্র। ৬৬’র ৭ জুন ঢাকার বনানী বাসা থেকে একমাত্র মেয়ে পুতুলকে আদর করে সেই যে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মনু মিয়া আর বাসায় ফিরে আসেননি। তাঁর লাশও পাওয়া যায়নি। তৎকালীন সরকার আরো অনেকের মতো মনু মিয়ার লাশ গুম করে দিয়েছিল। ৮ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ৭ জুনকে মুক্তি দিবস ঘোষণা করেন। ৭ জুন কেবল একটি দিন নয়। বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইঙ্গিতবাহী এদিন। ৭ জুনের পথ ধরে এসেছে ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ।

অনেক ঐতিহ্যের ধারক বিয়ানীবাজার। মহান মুক্তিযুদ্ধ,নানকার আন্দোলনসহ সবকটি আন্দোলন সংগ্রামে এ জনপদের মানুষ পালন করেছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। মনু মিয়া আমাদের অহংকার। সুখের কথা এই যে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে মনু মিয়ার বাড়িতে নির্মিত হয়েছে শহিদ মনু মিয়া স্মৃতিস্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের উদ্যোগে প্রায় সাড়ে ছয়লাখ টাকা ব্যয়ে বিয়ানীবাজারবাসীর বীরত্বের আইকন মনু মিয়া ৫১ বছর পর ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন আপন বাস্তুভিটায়। দেরিতে হলেও একটি মহৎ কাজ সম্পন্ন হচ্ছে । আমরা কিছুটা হলেও দায়মুক্ত হয়েছি। উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানাই।

  •  সাধারণ সম্পাদক, শহিদ মনু মিয়া স্মৃতি পরিষদ, বিয়ানীবাজার।

‘এবি টিভি’র সর্বশেষ প্রতিবেদন-