মানুষের সাথে মানুষের পরিচয় রক্তের বাঁধন ছাড়া পুর্ব নির্ধারিত নয়। জীবনে চলার পথে ভিন্ন ভিন্ন বাঁকে অপরিচিত জন পরিচিত হয়, সম্পর্ক গড়ে উঠে রক্ত বাঁধনের চেয়েও গভীর হয়ে ওঠে । তেমনী করে এক মায়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সদ্য মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত রেজাউল করিম ভাইয়ের সাথে। আপনজনকে ছাপিয়ে আমরা কতটা আপন ছিলাম সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। চাইলে পারবো না!

মনে পড়ে অনেক বছর আগের একটি স্মৃতি। সে সময় আমি ফুটবলে আজেন্টিনার খুব ভক্ত। বিশ্বকাপ খেলা চলাকালিন সময়ে আর্জেন্টিনার পতাকা কিনতে বিয়ানীবাজারের মেইন রোর্ডে কাপড়ের দোকান ঢুকলাম। ১৯/২০ বছরের যুবকের কাছে পতাকা চাইলাম। মধ্য সাইজের পতাকা বের করে দিয়ে আমার বাড়ি জানতে চাইলেন।
-বললাম, ‘মাত্থুরাত’
-দৃষ্টি উঠিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘মাত্থুরাত! কোন পাড়? কোন ক্লাসও পড়ো, ইস্কুলের নাম কিতা?’
-বললাম, ‘পশ্চিমপার। পিএইচজিতে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি।’ এই আলাপ।

সেদিন আমার কাছ থেকে পতাকার টাকা নিলেন না। নিজের পকেট থেকে ২০ ও ১০ টাকার দু’টি নোট বের করে ক্যাশে রাখলেন। সেই থেকে করিমের ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। এ পরিচয় থেকে দুইজনের সম্পর্ক সময়ের সাথে সাথে আপনজনের সম্পর্ককে ছাপিয়ে দুই ভাই হয়ে গেলাম। ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করলাম একে অপরকে।

নবম শ্রেণীতে উঠার পর বাজার কেন্দ্রিক চলাচল বাড়ে। প্রায় দেখা হয় করিম ভাইয়ের সাথে। তখনও জানতাম না তাঁর বাড়ি আর আমার বাড়ি থেকে হেঁটে চার মিনিটের পথ। সে সময় তিনি কসবায় খালার বাড়িতে থাকতেন। এরমধ্যে তিনি জামানপ্লাজায় রুপসী ফ্যাশন নামে দোকান খুললেন। নিজ গ্রামে বসতি গড়েন। আমাদের সম্পর্ক নিবিড় হতে থাকে। একপর্যায়ে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক পারাপারিক সম্পর্কে পরিণত হয়।

বড় ভাইয়ের ভুমিকায় করিম ভাই: তিনি সব সময় আমাকে আগলে রেখেছেন। ১৯৯৮ সালে করিম ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর থেকে আমায় ছোট ভাইয়ের মতো দেখেছেন। ছায়ার মতো মায়া দিয়ে আগলে রেখেছেন। লেখাপড়া বাদ দেওয়ার পর ফুলকলি ব্যান্ডের বেকারি বিভাগের ডিলার কসবার দেলোয়ার ভাইয়ে সাথে সমুন্নয় করে করিম ভাই বিনা ডিপজিটে মাথিউরায় ফুলকলি বেকারি প্রডাক্ট পৌঁছনোর ব্যবস্থার করে দেন। যদি বছর দু’এক পরে তা আমি কন্টিনিউ করতে পারি নি। পরবর্তীতে ফানির্চারের ব্যাবসায় হাত দেওয়ার করিম ভাইয়ের যে প্রেরণা পেয়েছি তা বলার ভাষা নেই। শুধু একটা উদাহরণ দেই-, আমার প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন সহপাঠি নিয়ে ভ্রমনের দল গঠন করি। ২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দেশের প্রায় দর্শনীয় স্থান ঘুরি। একদিন রুপসী ফ্যাশনে বসে তার সাথে গল্প করছি। এক সময় তিনি আমার কাছে এসে বললেন, ‘দেখ আমিও অনেক ঘুরেছি, কোন লাভ নেই। শুধু শুধু টাকা ও সময়ের অপচয়। যেহেতু নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছিস তাতে সময় দে, একসময় এ ব্যবসাই সবকিছু সহজ করে দেবে।’ জামান প্লাজার তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালুর পর এমন কোন ঈদ নেই যে আমাকে উপহার দেননি। কোন ঈদে আগের দিন বাজারে বা তাঁর দোকানে যাইনি চাঁদরাতে উপহার আমার বাড়িতে পৌছিয়ে তিনি বাড়ি গেছেন। আমার পছন্দের কিছু খাবার তাঁর বাড়িতে আয়োজন করা আর তিনি আমায় স্মরণ করেননি তা খুব কম। যদিও ইদানীং ব্যস্ততা বাড়ায় তাঁর আন্তরিকতার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারি নি। আমার পরিণয় পর্বে ভালো মান ও সাধ্যের মধ্যে কাপড় পছন্দ করার দায়িত্ব তাঁর ছিল।

বন্ধু করিম ভাই: অলরাউন্ডার করিম ভাইয়ের বন্ধু সুলভ আচরণে সকলকে মুগ্ধ করতো। ধীরে ধীরে আমার সাথেও তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। একে উপরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে শেয়ার করতাম। বিশেষ করে ২০০৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আমাদের অবিচিন্ন সম্পর্কের মধ্যে অতিবাহিত হয়। এরই মধ্যে পরিচয় হয় জামান প্লাজার শখ কসমেটিকসের খয়ের ভাই, বাসন্তী বস্ত্র বিতানের আলীম ভাই, শাপলা কসমেটিকসের বাবলু ভাই ও মতিন ক্লথ ষ্টোরের জোবায়ের মামার সাথে। তাঁরা আমায় আপন করে নেন। ভোজন বিলাসী করিম ভাইয়ের মধ্যে সব সময় ভিন্ন রকম, ভিন্ন স্বাদের খাবার আয়োজনের প্রবণতা ছিল। বিয়ানীবাজার থেকে হুট করে বাড়িতে পাঁচ কেজি গরুর মাংস পাঠিয়ে বলতেন সাতকরা দিয়ে রেঁধে সাথে মেরা পিঠা তৈরি করে রাখার জন্য। রাতে চার পাঁচজন খাবে। ইতিমধ্যেই আমাদের ম্যাসেজ দেওয়া হয়ে গেছে। রাতে খয়ের ভাই, আলীম ভাই, বাবলু ভাই, জোবায়ের মামাকে সাথে নিয়ে ঈদগাহ্ বাজার এসে আমাকে ফোন, ‘তাড়াতাড়ি বের হও আমরা অপেক্ষায় আছি’। খাবারের সকল আইটেম ঘরের ফ্লোউরে সাজিয়ে সবাই নিচে বসে খাবার পর্ব শুরু। এমনদিনও হয়েছে আমারা সব খাবার শেষ করে ফেলেছি। পরিবারের অন্যান্যরা আবার রেঁধে খেয়েছেন।

প্রায়দিন বিকেলে বৈরাগীবাজার, থানাবাজারে চানা পিয়াজু বা ত্রিমূখ বাজারের হামিদ মিয়ার হোটেলে লবঙ্গ, নিমকি খাওয়া নিয়মে পরিণত হয়েছিল। ক্রীড়াপাগল এ মানুষটির সাথে টিভি সেটের সামনে বসে খেলা দেখার অসংখ্য স্মৃতি আছে। দু’জন মিলে বিগ বাজেটের টুর্নামেন্টে টিম নিয়ে অংশগ্রহন করেছি। মাথিউরা বাজারে ইউনাইটেড ক্লাব আয়োজিত ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা আবাহনী ক্রীড়া চক্র নামে অংশগ্রহণ করে লক্ষাধিক টাকা খরচে জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় এনে ফাইনালে খেলেছি।

করিম ভাইয়ের বন্ধুবান্ধব অনেকে ধারণা করেতেন আমি তাঁর সমবয়সী। কারণ বন্ধুর মতো নানা আয়োজনে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমায়। বিশেষ করে তার বিয়েতে আমায় সব সময় রেখেছেন পাশে পাশে। আমার জীবনের কঠিন সময়ে বন্ধুরমতো কাছে থেকে বিষটির সুরাহা করেছেন।

সামাজিক ও রাজনৈতিক বান্ধব করিম ভাই: শিল্প সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সামাজিক কাজে ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকে। মাথিউরা তথা বিয়ানীবাজারে যতো সামাজিক কাজ করেছি তাতে করিম ভাইয়ের সহযোগিতা ছিল। কখনো আর্থিক কখনো শারিরীক কখনো বুদ্ধবৃত্তিক।
স্বাধীনতার স্বপক্ষের একটি রাজনৈতিক দলের সৈনিক ছিলেন তিনি। আদর্শিক প্রশ্নে আপোষহীন ক্ষণজন্মা এ মানুষটি নিজ সংগঠেন যথার্থ মূল্যায়িত হননি। তবুও তাঁর আদর্শে ছিলেন অবিচল। সংগঠনের যে কোন আচার অনুষ্ঠানে তাঁর আর্থিক অনুদান নেই তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একটি কথা খুব মনে পড়ে ২০০৮ জাতীয় নির্বাচনের আগে তাঁর অজান্তে ভিন্নমতের এক অনুষ্ঠানে রুপশী ফ্যাশনের ক্যাশ চেয়ার ব্যাবহার করা হয়েছিল। জেনে তিনি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েন। বাসন্তী বস্ত্র বিতানের আলীম ভাই এসে আমায় চোখ মেরে প্রথমে মজা করলেন পরে যখন করিম ভাই আরো ভেঁঙ্গে পড়ছিলেন আলীম ভাই সাথে সাথে ব্যাবসার দোহাই দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক করে ছিলেন। অসংখ্য স্মৃতি আর ঘটনা রয়েছে করিম ভাইয়ের সাথে তা বর্ণনা করতে গেলে অনেক সময়ে আর কয়েক দিস্তা কাগজ প্রয়োজন।

প্রিয় বিয়ানীবাজারবাসীর কাছে অনুরোধ, আমারা যদি দূর পাল্লার রাস্তা অতিক্রম করি তাহলে বাস অথবা ট্রেন জার্নিটা প্রথম হিসেবে বেঁচে নেবেন। যদি প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে যেতে হয় তাহলে সুবিধা স্থানে যাত্রা বিরতী, চালককে পর্যাপ্ত বিশ্রামে রাখতে হবে। গাড়ির সবাই যাতে ঘুমিয়ে না পড়ি সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত। কেননা সবাই ঘুমালে চালকের আপনা আপনি ঘুম চলে আসে। আসুন আমরা সচেতন হই। যাতে মানবতার ডাকে সাড়া দেওয়া বিয়ানীবাজারের প্রিয় ৫ তরুণ ব্যবসায়ী ও চালকের মতো নির্মম নিয়তি কারো যেন না হয়!