সিনিয়র ক্রীড়া প্রতিবেদক আলী সেকান্দার সাধারণত খুব কমই ফোন করেন। টের পাই ফোনের ও-প্রান্তে তার গলা কাঁপছে উত্তেজনায়- ‘ভাই, একটি এক্সক্লুসিভ খবর আছে। অনেক বড় এক্সক্লুসিভ।’

ভাবলাম, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কারও সাক্ষাৎকার বোধ হয়।

‘না না ভাই, সাক্ষাৎকার নয়; এটা আরও বড় খবর- সাকিবকে ১৮ মাস নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে আইসিসি।’

বিসিবির সঙ্গে দেশীয় ক্রিকেটারদের চলমান সংকটের মধ্যে হঠাৎ আইসিসি ঢুকে গেল কীভাবে? সেকান্দারের কথায় হিসাব মেলাতে পারি না। বিস্মিত হই। সাধারণ মানুষের মতোই মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক সন্দেহ।

গত সোমবারের বিকেলটা আমাদের বদলে যায় ওই একটি ফোনে। সেকান্দারই জানালেন, দু’বছর আগে জুয়াড়িদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলেও সাকিব সেটা গোপন করেছিলেন। আইসিসি আইনে যা কি-না বড় অপরাধ। সাকিব এ রকম একটি ঘটনার মুখোমুখি। বিশ্বাস করাই কঠিন।

সেকান্দার আরও জানালেন, এক্সক্লুসিভ এই খবর সমকাল ছাড়া অন্য কেউ ব্রেক করতে পারবে না।

সরাসরি তাকে অফিসে চলে আসতে বললাম। তারপর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলাম ক্রীড়া সম্পাদক সঞ্জয় সাহা পিয়ালসহ। যুক্ত হলেন টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) এস এম শাহাব উদ্দিনও।

সম্পাদক হিসেবে অনেকগুলো বিষয় তখন মাথায় ঘুরছে। সাকিব আল হাসান আমাদের সবচেয়ে বড় তারকা, আইসিসির সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই তাকে নিয়ে আমরা এ রকম একটি রিপোর্ট করে ফেলব? সেটা নীতিগতভাবে কতটুকু ঠিক হবে? সরাসরি উদ্ৃব্দত করে ব্যবহারের মতো সংশ্নিষ্ট কারও বক্তব্যও নেই আমাদের কাছে। কেউ স্বনামে কিছু বলবেন না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিবি এবং সাকিবের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্রের বক্তব্য থেকে আমরা শতভাগ নিশ্চিত হলাম, ঘটনাটি আসলেই ঘটতে যাচ্ছে এবং মঙ্গলবারই আইসিসি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে। এটাও নিশ্চিত হলাম, এর আগে আইসিসির ই-মেইল পেয়েই সাকিবকে অনুশীলন থেকে বিরত রেখেছে বিসিবি।

নৈতিকতার বিষয়টি তখন পরিস্কার। সিদ্ধান্ত হলো, সমকাল এ খবর ব্রেক করবে এবং এটা যাতে শুধু আমাদেরই এক্সক্লুসিভ থাকে, সে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। একই সঙ্গে দেশ এবং সাকিবের স্বার্থও দেখব আমরা। এ চিন্তা থেকেই তিনটি রিপোর্টের পরিকল্পনা হলো। তবে পেজ মেকআপের সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের জানানো হলো, প্রথম পাতায় জায়গা খালি রেখেই মেকআপ শুরু হবে। এক্সক্লুসিভ একটি নিউজ আসবে পরে। সম্পাদনা সহকারী বিভাগের দু’জনকে ডেকে এনে বলা হলো, প্রুফ দেখতে হবে গোপনে। সার্ভারে পাতা দেওয়া হবে না, গোপনে করা হবে মেকআপও। একটা ডামি হেডিং বসিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। কী হতে যাচ্ছে, কী নিউজ আজ লিড হচ্ছে? টের পাই সবার উত্তেজনা। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, কাউকে কিছু জানানো হবে না। এমনকি প্রথম সংস্করণ ছাপার পর সেটা সমকাল কার্যালয়েও আনা হবে না। নিরাপত্তা জোরদার করা হয় প্রেসেও।

বিষয়বস্তু অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ছাপার আগে গোপনে চুলচেরা বিশ্নেষণ চলে প্রতিবেদনের প্রতিটি বাক্য, এমনকি প্রতিটি শব্দ নিয়েও। সমকালের প্রথম পাতায় সাত কলামজুড়ে ছাপা হলো প্রধান প্রতিবেদনটি। সঙ্গে আরও দুটি সাইড স্টোরি। প্রথম সংস্করণে মূল শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ‘জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন করেন সাকিব’। দ্বিতীয় সংস্করণে সরাসরি তথ্য উপস্থাপনের কথা মাথায় রেখেই মূল শিরোনাম বদলে করা হলো ‘১৮ মাস নিষিদ্ধ হচ্ছেন সাকিব’। সাইড স্টোরি দুটির শিরোনাম যথাক্রমে ‘পাশে থাকবে বিসিবি’ এবং ‘আবেদন করবেন শাস্তি কমানোর’।

জানাই ছিল, এমন ‘বিস্ম্ফোরক’ প্রতিবেদন পরদিন সারাদেশে কেমন আলোড়ন সৃষ্টি করবে। বাস্তবে সেটাই হয়েছে। সমকালে প্রকাশিত সাকিবের খবরই ছিল গতকাল মঙ্গলবার সারাদিনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়, যাকে বলা হয় ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের একটা বড় অংশজুড়েও ছিল ক্রিকেট। আমারই এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী নিজেও উদ্ৃব্দত করলেন সমকালের রিপোর্ট।

সম্পাদক হিসেবে এমন একটা এক্সক্লুসিভ সংবাদ, যা অন্য কোনো কাগজে নেই, পত্রিকায় ছাপতে পারার আনন্দ কারও জীবনে খুব বেশিবার আসে না। মঙ্গলবার সকাল থেকে পাঠক, শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকের কাছ থেকেই বার্তা পেতে থাকি। সবার মুখে মুখে সমকাল।

সাংবাদিকতার এক শিক্ষক এসএমএস করলেন, ‘আজ দিনটি আপনার। আজ দিনটি সমকালের। যারা বলে প্রিন্ট সাংবাদিকতার দিন শেষ, আজ তাদের জন্য দুর্দান্ত জবাবের দিন।’ টিভি চ্যানেলগুলোর খবরে, টক শোতেও সমকালের প্রথম পাতার ছবি। দারুণ ব্যাপার।

সত্যিই কি তাই?

খোলামনে কিছু কথা বলতে চাই। সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে আমি খুবই আনন্দিত গতকালের প্রকাশিত পত্রিকাটি নিয়ে। শতভাগ বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে এ রকম স্পর্শকাতর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করাটা অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মতোই কঠিন। এই কঠিন কাজটি সফলভাবে করতে পারার জন্য আমি আমার সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানাই। নিউজরুমে, মেকআপে এমনকি প্রেসে পত্রিকা ছাপার সময় যারা গোপনীয়তা রক্ষা করেছেন, তাদের সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। কিন্তু একই সঙ্গে দিনটি সবার মতো আমার জন্যও ছিল নিদারুণ বেদনার। এ দেশের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানকে নিয়ে এ রকম একটি খবর প্রকাশের জন্য আমরা কিন্তু প্রস্তুত ছিলাম না মানসিকভাবে। সাংবাদিক হিসেবে এটা দায়িত্ব, যা ঘটবে তা পাঠককে জানানো। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনার অভিঘাত তো এমন, যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সাকিব শাস্তি পেতে যাচ্ছেন- এটা যেমন সমকালের বড় খবর ছিল, তার চেয়ে বড় দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে সেই শাস্তি ঘোষণার খবরটি। সমকালের খবর ধরে সবাই পরবর্তী ফলোআপ করছে। কিন্তু আমাদের যে মন ভালো নেই। এমন ভয়ংকর ‘এক্সক্লুসিভ’ খবর আর ছাপতে চাই না। আমাদের মতো হয়তো অন্যরাও চাইবে না।

বড় একটা ঝড়ের আভাস ছিল এবং সেটা শেষ পর্যন্ত শুধু ঝড় নয়, একই সঙ্গে সুনামি হয়েই আঘাত হানল। ক্ষতবিক্ষত হলো বাংলাদেশের ক্রিকেট। দেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিবকে শাস্তি পেতে হলো সামান্য ভুলের কারণে। মঙ্গলবার তাকে দুই বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। অবশ্য এর মধ্যে এক বছরের শাস্তি স্থগিত থাকবে ভুল স্বীকার করে নেওয়ায়। ফর্মের তুঙ্গে থাকার পরও আপাতত এক বছর সাকিববিহীনই চলতে হবে টাইগারদের। কখনও কখনও একটুখানি ভুলের জন্য কত বড় মাশুল গুনতে হয়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে গেলেন সাকিব। এই ঘটনাটি যেন আমাদের সব তরুণ ক্রিকেটার মনে রাখেন।

তবে লঘু পাপে যে গুরু দণ্ড দেওয়া হয়েছে সাকিবকে, তার বিরুদ্ধে আমাদের কথা বলতেই হবে। সরকার এবং বিসিবি বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিলে হয়তো আইসিসির এই কালো আইনটি পরিবর্তন হবে। এর আগে সনাথ জয়সুরিয়ার মতো ক্রিকেটারকেও একইভাবে ছয় মাসের শাস্তি পেতে হয়েছে। তখন কীভাবে কথা উঠেছিল আমরা জানি না, তবে এখন ভালোভাবেই কথা শুরু করতে হবে। আমাদের সাকিব ম্যাচ ফিক্সিং করেননি, করার মতো মানুষ নন। শুধু তার সঙ্গে জুয়াড়িদের কেউ কেউ যোগাযোগ করেছিল, সেটা ভুলবশত জানাননি বলে এত বড় শাস্তি দিতে হবে? মেনে নেওয়া যায় না। আমরা মানতে পারি না। এ মুহূর্তে শুধু এটুকু বলতে চাই, সারাদেশ সাকিবের পাশে আছে, আমরাও আছি। আমাদের সাকিব অবশ্যই আবার মাঠে ফিরবেন। বীরদর্পেই ফিরবেন।

-ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক সমকাল। (সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের কথা থেকে নেয়া)