জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো – স্কুল জীবনে শুধুমাত্র পরীক্ষা পাশের জন্য ভাবসম্প্রসারণ হিসাবে এ ধরণের কিছু বাণী মুখস্তই করা হতো। এ কথা গুলোর প্রকৃত অর্থ কী তা তখন অনুধাবন করতে না পারলেও জন্ম এবং কর্ম এই দুই এর পার্থক্য ও মাহাত্ম্য এখন আর বোঝার বাকি নেই। মানুষ আজীবন বেঁচে থাকে না। শুধু বেঁচে থাকে তাঁর কর্ম।

“যাপিত জীবন হোক সহজ সরল, চিন্তা হোক উঁচু মানের” এই ভাবনার প্রয়োগ ঘটিয়ে কাটিয়েছেন গোটা জীবন। তিনি হলেন সাম্যবাদী চেতনায় লালিত রণাঙ্গনের ‘যোদ্ধাহত’ বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক তিমির বরণ পাল চৌধুরী।

পঞ্চখন্ড তথা বিয়ানীবাজারের ঐতিহ্যবাহী পাল চৌধুরী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরেন্দ্র নাথ পাল চৌধুরী ও মাতা সুনীতি বালা পাল চৌধুরী।

বিয়ানীবাজার মডেল প্রাইমারী স্কুল, পিএইচজি হাই স্কুল ও এম.সি কলেজে কাটে তাঁর অধ্যয়নরত জীবনের বর্ণিল মুহূর্ত।

১৯৭০ সালে গোলাপগঞ্জের মীরগঞ্জ হাই স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করেন তাঁর চাকুরি জীবন।

১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ যখন পাকিস্থানি হানাদারদের হাতে নিগৃহিত, লাঞ্চিত। তখন এপ্রিলের শেষ দিকে দেশমাতাকে পরাধীনতার হাত থেকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যান করিমগঞ্জের হাইলাকান্দি। সেখানে ১ মাস ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে মেজর জেনারেল সি.আর দত্তের অধীনে যুদ্ধ করেন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখার কুকিতল ক্যাম্পে। এছাড়াও, জুড়ির বাগান এলাকায় পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় ডান পায়ের হাঁটুর নিচে গুলিবিদ্ধ হন।

দেশ স্বাধীন হবার পর পুনরায় মীরগঞ্জ হাই স্কুলে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালের ৩ মার্চ যোগদান করেন বিয়ানীবাজারের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ মাথিউরা দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ে। পেশাগত জীবনের পুরো অংশ এখানেই অতিবাহিত করে ২০১১ সালে অবসরে যান। পারিবারিক জীবনে তিনি ১ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক।

তাঁর স্বপ্ন ছিলো, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে প্রতিটি শিশুর মুখে হাসি থাকবে। পথে পরে না থেকে বিদ্যালয়ে যাবে। সৃজনশীল চেতনায় তারা সুন্দর জীবন গড়বে। তাদের হাত ধরেই গড়ে উঠবে সুখী, সুন্দর বাংলাদেশ।

প্রতিটি মানুষকে কাছে টানার এক অদৃশ্য শক্তির অধিকারী ছিলেন। যেন শত জনমের পরিচিত। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। জীবনের শেষ সময়ে এসে যখন বাস্তুহারা হয়েছিলেন, তখনও ছিলেন প্রচন্ড ধীরশক্তি সম্পন্ন। আশ্রয় হারিয়েও কাউকে দেননি কোন অভিশাপ। হন নি কারো দারস্থ, করেন নি কটুক্তি। যেন এক মহাপুরুষ। ক্ষনিকের জন্য মর্ত্যে এসে চলে গেলেন স্বীয় স্থানে।

২০২০ সালের মে মাসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেশ কিছু দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। সে সময় তাঁর সহকর্মী ও মাথিউরা দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা (ছেলে ও মেয়ে) উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েন। দেশে ও প্রবাসে অবস্থানকারীরাও তাঁদের এ প্রিয় শিক্ষকের পাশে এসে দাঁড়ান। সব সময় তাঁর খবরাখবর রাখেন। এতে বুঝা যায় তিনি শুধু একজন শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন তাঁদের আত্মার আত্মীয়।

২০২০ সালের ২৪ জুলাই জাতির এই বীর সন্তান বিয়ানীবাজারের খাসা গ্রামের ভাড়াটিয়া বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তাঁর ১ম মৃত্যুবার্ষিকী। সনাতন ধর্মীয় তিথি অনুসারে ১২ আগষ্ট তাঁর বাৎসরিক শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে।

তাঁর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক পরিচিতি : শিক্ষক ও নাট্যকর্মী
সভাপতি, শৌখিন নাট্যালয়

বিয়ানীবাজারে লকডাউনের প্রথম দিন: সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় ৬টি মামলা