বাবা আমাকে কখনো স্কুলে নিয়ে যাননি। ব্যাস্ত ছিলেন ভীষণ। স্কুলে নিয়ে যাওয়া, প্যারেন্টস-টিচার ইন্টারভিউ, স্যার ঠিক করে দেয়া, পড়ানো এই ধরনের সব কাজের দায়িত্ব ছিলো মামনির। কিন্তু তাও যখন আমাকে এস.এস.সি এ জি.পি.এ ফাইভ পাওয়ার পর কার অবদান বেশি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমি বলেছি বাবা। কারণ আমি বরাবর বাবার মেয়ে ছিলাম। বাবার মতো হতে চেয়েছি সবসময়। স্কুলে নিয়ে না গেলেও আমার সব বোর্ড পরীক্ষায় বাবা নিয়ে যেতেন। বাবা ছাড়া যেতে ভয় লাগতো। আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম, কিন্তু সবসময় আমার পরীক্ষা-ভীতি ছিল এবং এখনো আছে।

এস.এস.সি পরীক্ষার সময় বাবা আমাকে অনেকগুলো সাদা রঙের জামা কিনে দিলেন, যাতে একেক দিন একেক জামা পরে পরীক্ষা দিতে যাই। যেনো পরীক্ষা নয়, ঈদ। আমি বংশের প্রথম বাচ্চা, তার উপর প্রথম বোর্ড পরীক্ষা দিবো। সবার মনে যেন উৎসব! বাবা আমাকে বরাবর ওভার কনফিডেন্ট ভাবতেন, আমি জানতাম আমি এ-প্লাস পাবো। তখন হাজার হাজার এ-প্লাস ছিল না যদিও। আজ থেকে ১৪ বছর আগের এস.এস.সি এর কথা।

পরীক্ষার দিন বাবার হাত ধরে বাসা থেকে বের হলাম। গাড়িতে বাবা আর আমি পাশাপাশি বসা, আমার বুক ভয়ে কঁাপছে। আমি শুধু দোয়া পড়ছি। আমার ভয় লাগছে তা বাবাকে বলতে ইচ্ছা করছিলো না, বেচারা শুধু শুধু মন খারাপ করবে। গাড়ি হলের সামনে পৌঁছালে, বাবার হাত ধরে গেট পর্যন্ত যাই। এর মধ্যে সিলেটের সব পরিচিত মানুষজন এসে বাবার সাথে কুশল-বিনিময় আর আমাকে দোয়া দিতে শুরু করেন। পুলিশের সবচেয়ে বড় যে অফিসার উনিও আসেন বাবাকে হলের সামনে দেখে, এসে বাবাকে অভিনন্দন জানান মেয়ে এতো বড় হয়ে গেছে বলে!

এদিকে আমিতো এমনিতেই ভয় পাচ্ছি, আর গার্ডিয়ান ভিতরে যেতে পারবে না শুনে সবার সামনে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করি।

বাবা- কি হইসে রে বাবা।
আমি- বাবা ভয় পাচ্ছি।
বাবা- বাবা বলছি, দেখবা অনেক ভালো হবে পরীক্ষা। (আমি বাবার বুকের ভিতর মাথাটা লুকিয়ে শুধু ভ্যা-ভ্যা করে কেঁদেই যাচ্ছি।)

এমন সময় পুলিশের সেই বড় অফিসার এসে আমাকে বলেন, মা তুমি হলে একজন বাঘের বাচ্চা, তোমাকে ভয় পেলে চলবে? জীবনে আরো অনেক পরীক্ষা আসবে, সব পরীক্ষায় কি বাবা নিয়ে যাবে? বাঘের বাচ্চাদের ভয় পেলে চলে না।

বাবা তখন আমাকে বললেন, শুনেছো চাচ্চুটা কি বলেছেন? তুমি বাবার মেয়ে, তুমি ভয় পেলে কি চলবে। বাবা কি সব পরীক্ষায় নিয়ে যেতে পারবো? দেখবা পরীক্ষা অনেক ভালো হবে।

বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি বাবার গালে চুমু দিয়ে বাঘের বাচ্চার মতো পরীক্ষার হলে ঢুকলাম।

এখন আমি পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশন ছাত্র, ডাক্তারের সারাজীবন পরীক্ষা দিতে হয়। এখন আর বাবা পরীক্ষার হলে নিয়ে যান না। আমার স্বামী নিয়ে যায়। এখনো পরীক্ষার দিন ওকে জড়িয়ে ধরে ভ্যা-ভ্যা করে কাঁদি। ও আমাকে অবাক করিয়ে বলে, দেখবা পরীক্ষা অনেক ভালো হবে! আমি অবাক হই, কিছুই বলি না।

লেখক- সিলেট জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান আহমদের কন্যা।