অমল কান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল! তার বন্ধুরা কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল হতে চেয়েছিল। তবে তাদের কেউ একজন মাস্টারও হতে চেয়েছিল। শ্যামল কান্তি হয়তো সেই বন্ধুদের একজন; যিনি শিক্ষক হয়েছেন।

শ্যামল কান্তি শিক্ষক না হয়ে যদি রোদ্দুর হতে চাইতেন তবেই বুঝি ভালো করতেন; অপমানিত জীবন নিয়ে আজ কারাগারের বদ্ধ কুঠুরিতে দিন কাটাতে হতো না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমল কান্তির মতো হয়ত অন্ধকার ছাপাখানায় কাজ করতেন। ক্ষমতার নোংরা রাজনীতির শিকার হতে হতো না; এমন অপমানিত জীবন পেতে হতো না।

শ্যামল কান্তি শিক্ষক না হয়ে আর অন্য অনেক কিছুর একটা কিছু হলে আজকের অপমানের গ্লানি বইতে হত না। শ্যামল কান্তি তার এলাকার ক্ষমতাধর ব্যক্তির ক্যাডার বা চাটুকার হয়ে ক্ষমতাবান হতে পারতেন; উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকের মতো দলবাজি করতে পারতেন। ওই সবের কিছুই না করে তিনি শুধু শিক্ষক হয়ে রইলেন। জাতির মেরুদণ্ড বিনির্মাণের কারিগর হয়ে কাজ করে যেতে চাইলেন। তার চারপাশে কত শিক্ষক অপমানিত হলেন, শারীরিকভাবে নির্যাতিত হলেন ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও তাদের ক্যাডারদের দ্বারা। শ্যামল কান্তি ওই সব ঘটনা থেকেই কিছুই শিক্ষা নিলেন না।

এত কিছুর পরও তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেন। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পরেও তিনি পালিয়ে গেলেন না। সামান্য কিছু টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে অভিযুক্ত হবার মতো অমার্জনীয় অপরাধ করেও বুক ফুলিয়ে আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করলেন। শ্যামল কান্তি হয়ত ভুলে গেছেন পণ্ডিত সক্রেটিস কী বলেছেন! ধনী লোকের কাছে আইন হলো খোলা আকাশের মতো, আর গরিবের কাছে মাকড়সার জালের মতো। ধনী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি কত সহজে জামিন পেয়ে গেছেন আগের দিন। তার প্রতি নিষ্ঠুর অমানবিক নির্যাতন করার মতো গর্হিত অপরাধ করেও কত সহজে জামিন পেয়ে গেলেন, কারণ আইন তার কাছে, তাদের কাছে খোলা আকাশের মতো। আর শ্যামল কান্তিদের কাছে আইন মানেই মাকড়সার জাল!

শ্যামল কান্তি আপনি কি এখন বুঝতে পেরেছেন যে আদালত কেন আপনাকে জামিন দেয়নি? আপনার কোনো কাজে কি আদালতের এমন আশঙ্কা হয়েছিল যে আপনি জামিন পেয়ে পালিয়ে যাবেন? অথবা এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার নাম করে আরো অন্য শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের সাথে প্রতারণা করবেন?

আপনার স্ত্রী বলেছেন, আপনাকে নাকি পুলিশ ৫০ লক্ষ টাকা অফার করেছিল টাকা নিয়ে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে। আপনি সে প্রস্তাবেও রাজি হননি। আইনের লোকদের আদেশ অমান্য করার মতো ধৃষ্টতা আপনি দেখাতে পারলেন?

একজন আইন প্রণেতা আপনাকে কান ধরে উঠবস করিয়েছিল সবার সামনে। তাতে আপনি সম্মানিত বোধ করতে পারতেন! কিন্তু তা না আপনি অপমানিত বোধ করেছিলেন। অবশ্য, তাতে আপনার একার দোষ না। আমরা কিছু লোক সে সময় উস্কানি দিয়েছিলাম অপমানিত বোধ করতে। শিক্ষকের সম্মান গেলো, সম্মান গেলো বলে আমরা জিগির তুলেছিলাম। আমরাও দলে দলে কান ধরে উঠবস করে মজা পেয়েছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই ছবি আপলোড করার হিড়িক পড়েছিল। তখনও আপনি ভুল করেছেন এই ভেবে যে সবাই আপনার সাথে আছে। আমরা তো ফেসবুকে লাইক পাবার জন্য আর আরামে বসে মজার মজার কথা বলে জ্ঞান জাহির করার আনন্দ পেয়েছি। এখন আপনি একা। কারাগারে বন্দি জীবন আপনার কেমন লাগছে? নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন?

শ্যামল কান্তি, আপনি যদি শিক্ষক না হয়ে একজন ট্রাক ড্রাইভার বা বাস ড্রাইভার হতেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থার আইনের ফাঁক ফোকর গলিয়ে দুই চারটা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে নিতেন অনায়াসে। দুই চারজন মানুষকে বাস বা ট্রাক চাপা দিয়ে মেরে ফেললেও আপনি এমন একা বোধ করতেন না। পুলিশ আদালত আপনাকে জেলে ভরতে চাইলে আপনার সঙ্গী সাথীরা রাস্তায় আন্দোলন করতো। দুই একজন মন্ত্রী এমপি পর্দার আড়াল থেকে আন্দোলনকে উস্কে দিতো। সরকারের সাথে দর কষাকষি করতো; আপনার মুক্তির জন্য। আপনার মুক্তির আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত বাস ট্রাক চলাচল বন্ধ রেখে জনজীবন স্থবির করে দেওয়া হতো। আপনি বাস বা ট্রাক ড্রাইভার না হয়ে শিক্ষক হলেন!

আপনি নিশ্চয় বাদশাহ আলমগীরের মহানুভবতার কথা জানতেন। শিক্ষকের মর্যাদা কিভাবে দিতে হয় সেটা জানতেন বাদশাহ আলমগীর। আপনি পড়েছেন সেই কবিতার লাইনগুলো—“উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে/ কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে- আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।”

কিন্তু কেন ভুলে গেছেন আপনি বাদশাহ আলমগীরের সাম্রাজ্যে বসবাস করেন না?

আপনি নিশ্চয়  জীবনানন্দ দাশের “অদ্ভুত আঁধার এক” কবিতাটি পড়েছেন। আবার পড়বেন।

“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়

মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।”