এত চোখের এত এত স্বপ্ন যেখানে ঘুড়ি হতে চায় সেখানে ঘুড়ির জন্য হাওয়া না থেকে কি পারে, এত মুখের কথা যেখানে এত এত ফুল হতে চায় সেখানে কি আলো না থেকে পারে? বার্মিংহামের আকাশের আলোতে টাইগারদের অন্তরের শক্তিই প্রজ্বলিত হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে তীব্র আকর্ষণের ম্যাচটিই মধুর প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছে। পুঞ্জ পুঞ্জ ক্ষোভে বেড়ে ওঠা একটা জেদ, বিশ্বাস- অবিশ্বাসে তৈরি হওয়া একটা অভীপ্সা, একটা না পাওয়ার বেড়ে ওঠা শূন্যতা-আত্মগ্লানির সব কারুণ্য আজ বিস্ম্ফোরণের অপেক্ষায়। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের ওই ‘রহস্য’মণ্ডিত ম্যাচের পর অবিশ্বাসের চোরা স্রোত বইছে এজবাস্টনে। ‘কারও মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। জানি, আমাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হবে। ভারত কঠিন প্রতিপক্ষ, কিন্তু অজেয় নয়…।’ গতকাল মাশরাফির বলা এই কথাটির গভীরতা মাপতে গিয়ে পাশে বসা মুম্বাই থেকে আসা এক সাংবাদিক বলেই ফেললেন- ২০০৭ বিশ্বকাপের সময় আমি এই চেহারা দেখেছিলাম বাংলাদেশের মধ্যে।

এবারও কি সেই চেহারায় ফিরে আসবে টাইগাররা? আজ হারলেই যে সেমির আশা শেষ। পরের ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে ৯ পয়েন্ট নিয়ে সেমিতে যাওয়া আর সম্ভব নয়। ২০১৬ সালে মিরপুরে এশিয়া কাপের ফাইনাল, ব্যাঙ্গালুরুতে টি২০ বিশ্বকাপের নাটকীয় ম্যাচ, গত বছর কলম্বোয় নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল এবং এ বছর দুবাইয়ে এশিয়া কাপের ফাইনাল- কোথায় যেন একটা ‘লাইন অব কন্ট্রোল’-এ গিয়ে আটকে যাচ্ছে টাইগাররা। এবার এই বার্মিংহামেই সেই লাইনটা পেরোতে চান মাশরাফিরা। শেষবার ভারতকে হারানোর আনন্দ উপভোগ করা গেছে চার বছর আগে। তারপর ওয়ানডে আর টি২০ মিলিয়ে ১২ ম্যাচ খেলা হলেও জেতা হয়নি আর। এবার অন্তত দলের পাঁচ মাথা (মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক আর মাহমুদুল্লাহ) মিলে একটা কৌশল ঠিক করেছেন। অতীত অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছেন এবার আর ‘ভারতকে হারতেই হবে’ বলে বোধবুদ্ধিশূন্য হয়ে নয়, ভীষণ কৌশলী হয়ে ‘আমাদের জিততেই হবে’ নীতিতে হাঁটতে হবে। আবেগকে সামলে শুরুতেই একটি ধাক্কা দিতে হবে।

ভারতকে হারানোর যে কৌশলগুলো টাইগারদের টিম মিটিংয়ে ল্যাপটপ ঘেঁটে দলের কম্পিউটার অ্যানালিস্ট বের করেছেন তা অনেকটা এমন : ১ . বোলিং পেলে শুরুর দশ ওভারে রোহিতকে ফিরিয়ে দাও; স্পিন নয়, মুস্তাফিজের শর্ট বল সে ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। ২ . কোহলিকেও অফস্টাম্পের বাইরে বুকসমান বল দাও, রুবেলকে দিয়ে সেটা হতে পারে। ৩. ঋষভ পান্ত, মহেন্দ্র সিং ধোনি আর হার্দিক পান্ডিয়ার সামনে বেশি বেশি ডট বল দেওয়ার চেষ্টা করো, তাহলেই চাপে পড়ে ক্যাচ তুলবে। বোলিংয়ে সাকিব আর মোসাদ্দেককে আনতে হবে এই সময়। ৪. ডেথ ওভারে সাইফউদ্দিন আর রুবেলকে দিয়ে রান ছয়ের কাছাকাছি রাখার চেস্টা করো, তাতে তিনশ’র আশপাশে রান আটকানো যেতে পারে। ৫. ব্যাটিং পেলে শুরুর দশ ওভারে উইকেট ধরে রাখার চেষ্টা করা, ভারতীয় পেসার বুমরাহকে ছেড়ে বাকি বোলারকে টার্গেট করো। সৌম্য কিংবা লিটনকে দিয়ে বারুদের মুখে খসিয়ে রান তুলে নেওয়া। ৬ . সাকিব, মুশফিক কিংবা রিয়াদের সঙ্গে একটি বড় জুটি গড়ে তোলা। ৭. যেহেতু মাঠের এক দিকটা বেশি ছোট, সেহেতু দু-দিক থেকে কোনোভাবেই স্পিন চালিয়ে না যাওয়া।

সেদিন ইংল্যান্ড যেভাবে ভারতকে আটকে দিয়েছিল সেই কৌশলই কি নিতে পারে না বাংলাদেশ? এক ব্রিটিশ সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন মাশরাফির কাছে। শুনে মাশরাফি যে হাসিটা দিলেন তার ভাষা হতে পারে এমন- ওই ম্যাচটির কোনো কিছুই বিশ্বাসযোগ্য নয় ! ‘ইংল্যান্ডের কোনো কিছু নয়, আমরা আমাদের পরিকল্পনাটাই কাজে লাগাব।’ আগের দিন যে পিচটিতে ধোনিরা শেষ ৩১ বলে ৩৯ নিয়েছিলেন, যে মাঠে মাত্র একটি ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন, আজও সেই একই পিচে একই বাউন্ডারির মাপে খেলা হবে। আর এই ধরনের পিচে সাধারণত স্পিনটা একটু ভালো ধরে থাকে। সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের মতো ধারাভাষ্যকাররা বলছিলেন যে কুলদিপ যাদব আর যুজবেন্দ্র চাহাল দুই ভারতীয় রিস্ট স্পিনারের জন্য বাড়তি সুবিধাও হতে পারে। কিন্তু ওসব কানকথা শুনছেন না আর মাশরাফিরা। তারা প্রস্তুত হয়ে আছেন নিজেদের মতো করেই।

জিতলে সেমির স্বপ্ন বেঁচে থাকবে, হারলে বাদ- এসব ভেবে মাথা গরম করতে রাজি নয় টাইগাররা। তাদের সামনে এখন একটিই লক্ষ্য- কোহলিদের আজ দেখিয়ে দিতে হবে বাংলাদেশিরা কারও মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে না। এদিন এজবাস্টনে টাইগারদের অনুশীলনের বাইরে দাঁড়িয়ে স্টারস্টোপসের ভারতীয় সাংবাদিক হিন্দিতে বেশ নাটকের সুরে বলছিলেন- ‘এটা বাংলাদেশের ডু অর ডাই ম্যাচ, আর ভারতের সেমিতে ওঠার। আজই সেমি নিশ্চিত করবে মেন ইন ব্লু…।’ সংবাদ সম্মেলনেও এক ভারতীয় মাশরাফির কাছে জানতে চেয়েছিলেন হারলেই তো আপনাদের সেমির স্বপ্ন শেষ। তাকে সংশোধন করে দিয়েছিলেন মাশরাফি- ভারতও কিন্তু এখনও সেমি নিশ্চিত করতে পারেনি।

সুকৌশল কিংবা কূটকৌশল যে কারণেই হোক না কেন, আগের দিন ভারতের অমন স্লো ব্যাটিং কোনো ক্রিকেট মস্তিস্কের কাছেই পরিস্কার কোনো বার্তা দিতে পারেনি। আজ যদি বাংলাদেশ জিতে যায় তাহলে টাইগারদের পয়েন্ট দাঁড়াবে ৯। পরের ম্যাচে পাকিস্তানকে হারাতে পারলে সেটা হবে ১১। আর ভারত যদি বাংলাদেশ আর শ্রীলংকার কাছে পরপর দুটো ম্যাচ হেরে যায় তাহলেও তাদের পয়েন্ট দাঁড়াবে ১১। ইংল্যান্ড যদি নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে যায় তাহলে তাদের পয়েন্ট হবে ১০। সুতরাং ‘পিকচার আভি বাকি হে…’। আপাতত এই ম্যাচটি সেমির সমীকরণের না যতটা, তার চেয়েও বেশি মযার্দার।

পাড়ার দেয়াল থেকে ফেসবুকের ওয়াল, চায়ের আড্ডা থেকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ- ষোলো কোটির চাওয়াটা কী? তা জানা আছে এগারো বাংলাদেশির। এটাও জানা আছে কোহলিদের হারাতে পারলে কী তোলপাড় পড়ে যাবে ক্রিকেট বিশ্বে। জেনেই লেখা, এই ম্যাচটি নিয়েই দু’বছর ধরে কতটা চিন্তা-পরিকল্পনা করা হয়েছে। কত কৌশল ঠিক করা হয়েছে। আজ শুধু ভালো খেলাই নয়, কপালটাও সঙ্গে চান মাশরাফি। চান শুরু থেকে শেষ অবধি এতটুকু সময়ের জন্যও যেন তার ছেলেরা মাঠে গা ছেড়ে না দেয়। কারণ এটাই হয়তো ভারতের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎ, শুরুর মতো সমাপ্তিটাও স্মৃতির অ্যালবামে আলো জ্বেলে থাকুক। কানে এসেছে এই ম্যাচ শুরুর আগে একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা তৈরি করে রেখেছেন সাকিব। সবার মধ্যে ঘুমন্ত বাঘটিকেই জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। আজ অন্তত আরেকবার গর্জে উঠুক টাইগাররা।