আজ ঐতিহাসিক ৭ জুন। ১৯৬৬ সনের এইদিনে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা তথা স্বাধিকার আন্দোলনে প্রথম শহীদ হন পঞ্চখণ্ড তথা বিয়ানীবাজারের সূর্য সন্তান ফখরুল দৌলা মনু মিয়া।  শ্রমিক মনু মিয়ার আত্মদান ছিল সে আন্দোলনের সবচেয়ে মহিমান্বিত। একজন সাধারণ মানুষ থেকে স্বদেশের জন্য, স্বজাতির জন্য আত্মত্যাগের মাধ্যমে অসাধারণ হয়ে ওঠেন মনু মিয়া।

মনু মিয়ার পুরো নাম ফখরুল দৌলা মনু মিয়া। বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বড়দেশ গ্রামে, বর্তমানে তাদের পরিবার পৌরশহরের নয়াগ্রামে চলে এসেছেন। পিতা মনহুর আলী খানের ৬ পুত্র ও ৩ বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিনি। পরিবারের আর্থিক অভাব অনটনের কারণে প্রাথমিক শিক্ষার বেশী লেখাপড়া করতে পারেননি। ২০-২২ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়ীতে গৃহস্থালী কাজ করেন। অতঃপর জীবন ও জীবিকার তাড়নায় ঢাকায় পাড়ি দেন। গাড়ী চালনা শেখে চাকুরী নেন এক কোমল পানীয়ের কোম্পানীতে।

৬ দফা আন্দোলন তখন বেগবান হচ্ছে। তুমুল থেকে তুমুলতর হচ্ছে বাঙালির প্রতিদিনের প্রতিরোধ সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম মনু মিয়ার কাঁদা-জল মাখা শরীরেও দোলা দেয়। একেবারেই গ্রাম থেকে ওঠে আসা শ্রমিক মনু মিয়ার শরীরে তখনও ছিল মাটির ঘ্রাণ, তার শ্রমিক দেহে প্রতিবিন্দু ঘামে ছিল মেহনতি মানুষের আমরণ লড়াইয়ের প্রত্যয়। মৃত্যু পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সেই প্রত্যয় ধারণ করেছিলেন মনু মিয়া। আওয়ামী লীগের ব্যানারে তিনি নেমে আসেন রাজপথে, ব্যস্ত হয়ে পড়েন মিছিল-মিটিং আর ধর্মঘটে।

৭ জুন সকাল ১১টা। তেজগাঁও শিল্প এলাকার শ্রমিক কর্মচারীরা মিছিল নিয়ে রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। অবস্থান নেয় তেজগাঁও রেলস্টেশনের আউটার সিগনালের কাছে। অবরোধ করে রেল লাইন। পুলিশ প্রহরায়ও রেল চালানো ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ প্রতিবাদকারী শ্রমিক-জনতার উপর গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ৩০ বছর বয়সী শ্রমিক মনু মিয়া।

সেদিনের শ্রমিকদের ডাকা সেই হরতাল চলাকালে মনু মিয়া ছাড়াও নাম না জানা আরো অনেকেই শহীদ হন। কিন্তু মনু মিয়ার সে আত্মত্যাগ অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মনু মিয়ার লাশ নিয়ে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকরা বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা দেশ।

মনু মিয়ার আত্মদানে স্মৃতি বিজড়িত ৭ জুন ছিল স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ এবং ৬ দফা তথা বাঙালির স্বাধীকারের পক্ষে প্রথম আত্মবিসর্জন। ৬ দফা থেকেইে আসে ছাত্রসমাজের ১১ দফা, সত্তুরের নির্বাচনী বিজয়। এরই ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

স্বাধীনতার পর শহীদ মনু মিয়ার স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেয় বঙ্গবন্ধুর সরকার। রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও নাখালপাড়ায় তার নামে ‘মনু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে শহীদ মনু মিয়ার কোনো স্মৃতিচিহৃ রক্ষার্থে বিয়ানীবাজারের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের অর্থায়নে স্থাপনকৃত স্মৃতিসৌধ ২০১৭ সালের ১৯ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।

এদিকে, গত ৫ জুন বিয়ানীবাজারে শহীদ মনু মিয়া স্মৃতি পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে দুর্যোগপূর্ণ এ পরিস্থিতিতে ৭ জুন কোনো আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি পালন না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে স্ব স্ব উদ্যোগে নিজগৃহে অবস্থান করে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আত্মোৎসর্গকারী মনু মিয়াসহ সকল শহীদের রুহের মাগফেরাত কামনার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আলী আহমদ ও সদস্য সচিব খালেদ সাইফুদ্দীন জাফরী।

‘এবি টিভি’র সর্বশেষ প্রতিবেদন-