আজ চলে গেলেন বিয়ানীবাজারের অতি পরিচিত মুখ, বিয়ানীবাজার উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ট বিদ্যোৎসাহী নুরুল হক। কোন প্রকার সতর্কীকরণ নোটিশ ছাড়াই নুরুল হকের প্রস্থান। যেমন কলিতে ঝরে যাওয়া। একেবারেই অকালে! নাফেরার পথ দিয়েই তিনি চলে গেছেন। তিনি অামাদের মধ্যে অার কখনও ফিরবেন না। তাঁর এই মৃত্য বড়ই দুঃখের। বড়ই বেদনার। আমাদের এলাকাসহ সিলেটের ক্রীড়িঙ্গন অনেকটা শোকে মাতম। সর্বজনে একটি কথা, হায়! হায়! কি হলো। কি করে হলো। নুরুল হকে’র মৃত্যু কারো কাছে বিশ্বাস যোগ্য হচ্ছেনা। আমরা এখনই তো তাকে অশ্রুজলে বিদায় জানাতে প্রস্তুত ছিলাম না। এরপরও মেনেনিতে হচ্ছে এই অপ্রিয় দুঃসংবাদ।

চির সবুজ স‌তেজ হা‌সি‌তে ভরা মুখখা‌নি, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনের নানান কর্ম চাঞ্চল্যতায় সদা ব্যস্থ নুরুল হক আমাদের প্রাণে চেয়ে আর ডাকবেন না। আমাদের দিকে থাকাবেন না। অামাদের কোলাহলে ফিরবেন না। পিএইচজি হাই স্কুল মাঠের দর্শক কোলাহলে কোন ব্যস্থতার মধ্যে তাকে দেখা যাবেনা। নিষ্ঠুর এই মরণের কাছে জীবনের পরাজয়…

প্রবাসের সাড়ে তিন বছরে অামার অনেক কাছের প্রিয়জন, স্বজন, পরিচিতজন তাবৎ এই জগত সংসারের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। তাঁদের পদাঙ্ক করে, নিরবে নিভৃতে চলে গেছেন নুরুল হক। জন্ম মাত্রই’তো মৃত্যুর সাধ গ্রহন করা। যদি সেটা, অকালে হয়। জীবন যদি অকালে ঝড়েপড়ে। জীবনের এই মৃত্যু মানুষকে কাঁদায়- ভাবায়। পরিবেশে নেমে অাসে শোকের বিষন্ন গাম্ভীর্যতা। নুরুল হকের মৃত্যতে অাজ অামার শৈশবের কৈশরের বেড়েওঠা অঙ্গিনায় শোকে বিহ্বল।

আমরা একই গ্রামের বাসিন্দা হওয়তে সেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর সাথে অামার পরিচয় ও তিনির বাড়িতে অামার অবাদে যাতায়াত ছিলো। নুরুল ভাই অকালে চলে যাবেন এটা অনেকে যেমন ভাবতে পারেননি। মেনেও নিতে পারছেন না। অামি তাঁদেরই মতো শোকে নিরব নিস্তব্ধ চিত্তে বারবার নির্বাক হচ্ছি। গত দুদিন অাগেও কোন এক প্রসঙ্গে তাঁর কথা মনে পড়েছে। মনস্থির করেছিলাম একটু সময় হলে কথা বলবো। সেই কথাগুলো মনের মধ্যেই অপ্রকাশিত থেকে গেলো।

নুরুল হক’র ( নুরুল ভাইর) সাথে অামার অনেক স্মৃতি। তিনির মরহুম চাচা কৃতি ফুটবলার মহব্বত অালী কুতিল চাচার সাথে অামার মরহুম পিতা কৃতি ফুটবলার মরহুম বদরুল হকের সাথে বন্ধুত্ব ছিলো। সেই কারণেই দুই পরিবারের সম্পর্কের সূত্রধরেই শিশুকাল থেকে বাবার সাথে তাঁদের বাড়িতে যাতায়াত। আমাদের প্রাইমারী স্কুলটা তাঁদের বাড়ির সাথে হওয়তে, স্কুলে অাসা যাওয়ার পথে তাঁকে দেখতাম। ১৯৮২- ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দেখতাম স্কুলের বার্ষিক নানান অনুষ্ঠানাধীতে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহন। ১৯৮২ সালে অামাদের স্কুলে যাদু প্রদর্শনী করতে এক যুদুকর অাসেন। লোকজন বলবলি করছিলো যাদুকর মানুষ কাঁটবে! কাঁটা মানুষ অাবার জুড়া লাগাবে। ছাত্রছাত্রী ও গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে স্কুলের হল ভর্তি। অামি বসেছিলাম কুতিল চাচার মেয়ে সাবিয়া অাপা ও নুরুল ভাইর বোনদের কাছে। মানুষ কাঁটবে অনেকের বলাবলিতে ভয়ে কান্না অাসছিলো। তখন বিকাল হয় হয়। ভয়ে অামি বাড়ি অাসতে চাইলে, নুরুল ভাই অামাকে সাবিয়া অাপার কোলে বসিয়ে দেন। সেই সময় কয়েকটি ছবিও তোলেন। সেই স্মৃতিকথা অাজও মনের জানালায় উকিদেয়।

একজন চৌকশ গোলরক্ষক নুরুল হক ও অামি। আমরা দু’জন ক্রীড়া পরিবারের সন্তান। খেলাধুলা নিয়ে অামরা একসাথে অনেক পথ হেঁটেছি। আমরা একসাথে মাঠে খেলাও পরিচালনা করেছি। খেলার মাঠে জাজমেন্ট নিয়ে সমস্যা হলে কি করতে হবে বলে দিতেন। ৯৭ সালে সিলেট স্টেডিয়ামে অান্তঃথানা ফুটবল টুর্ণামেন্টে আমাদের বিয়ানীবাজার একাদশকে ষড়যন্ত্র করে হারানোর পর ম্যাচ ফিরে পাওয়ার জন্য অামরা যারপরনাই চেষ্টা করেছি। মিডিয়াই তখন হয়ে ওঠেছিলো আমাদের ভরসার জায়গা। ৯৫ সালে কুড়ারবাজারের গোবিন্দ্র বাশবাগান মাঠে খেলা পরিচালনা করতে যাওয়ার পথে কুশিয়ারা নদীতে অামাদের নৌকা দিশা হারায়। ভয় অার সাহসের নির্ভরতায় নৌকা তীরে ভিড়ে। সে অনেক কথা, নদীর তীর ঘেঁষা বাশবাগান মাঠের খেলায় ফাজিল ফুটবলার সময় ক্ষেপন করতে, কিক দিয়ে ভরা যৌবনা কুশিয়ারা নদীতে একের পর এক বল ফেলে দেয়!

লাউতা হাইস্কুল মাঠের টুর্ণামেন্টের জাজমেন্ট করতে নুরুল হক, ইসলাম উদ্দিন ভাইর সাথে অামিও গিয়ে ছিলাম। মাঠের রেফারির ভুলের জন্য জাজমেন্ট নিতে টুর্ণামেন্টের দুপক্ষের লোকজন তাঁদেরকে চেপে ধরেছিলেন। এখনই খেলার ফলাফলের সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য। সেদিন বৃষ্টি অামাদের রক্ষা করেছিল! অান্ত:স্কুল ফুটবল টুর্ণামেন্টে পিএইচজি হাই স্কুল মাঠে ভ্যানু হলে, নুরুল ভাই ও ইসলাম ভাই’র কথা বলে অামাদের শ্রদ্ধেয় স্পোর্টস শিক্ষক মরহুম অা.স.ম মান্নন স্যারকে ঠকাতাম।

একটা সময় সিলেটে চলে গেলাম। জীবনের মোড় বদল হলো, খেলার বদলে লেখালেখির দিকে ঝুকে পড়লাম। এই সুবাদে বিয়ানীবাজারে ক্রীড়াঙ্গনের খেলার খবর জাতীয় ভাবে প্রকাশ করতে নুরুল ভাই তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করতেন। অামি নির্দ্বিধায় বলতে পারি মফস্বল উপজেলা থেকে অামার হাত দিয়ে বিয়ানীবাজার এর ফুটবল টুর্ণামেন্টের যতোগুলা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যরা সেটা করে দেখাতে পারেননি। একারণে নুরুল হকরা সুনজরে রাখতেন।

শিক্ষা সংস্কৃতি ক্রীড়াঙ্গনে একজন বলিষ্ঠ নীতিনির্ধারক হিসেবে তাঁর পদচারণা ছিলো সর্বক্ষেত্রে। তাঁর এই অকাল শূণ্যতা কখনও পুরণ হবার নয়।

আমরা তাঁকে অশ্রুজলে বিদায় জানাতে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করি। খোদা যেনো তাঁকে জান্নাত দান করেন। অামিন।

লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।