অত্যন্ত বেদনা বিধুর চিত্ত নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসেছি , কিছু একটা কম্পোজ/টাইপ করার জন্য, মনে কিছুই আসছে না, অথচ স্মৃতির জানালা পরিপূর্ণ নস্টালজিয়ায়! মা বাবা হতে অনেক দূরে রয়েছি , প্রবাস জীবনে। মাকে হারিয়েছি , বাবাও অসুস্থ , শাসন করার প্রিয় শ্রদ্ধেয় মানুষগুলোকে একে একে হারাতে বসেছি। আজ টোরোন্টোয় আমার গ্রামের বড় ভাই , বিয়ানীবাজার এসোসিয়েশন টরন্টো কানাডার সভাপতি প্রিয় টুনু ভাই আমাকে ফোন করে প্রথমেই জানালেন, ‘সুহেল আমাদের মতিউর রহমান স্যার আমাদের মাঝে আর নেই ” শুনতেই হৃদয়ে প্রচন্ড রকমের একটা ধাক্কা লাগলো , বিশ্বাস হচ্ছিলনা সংবাদটি। আমার সাথে তখন ছিল টোরোন্টোয় আমার এক প্রতিবেশী ছোট ভাই তানভীর , আমাকে জিজ্ঞাসা করলো , “সুহেল ভাই, কি হয়েছে? কোনো খারাপ সংবাদ ?” আমি বললাম,”তানভীর আমি আমার আরো একজন অভিভাবককে হারালাম, এইমাত্র সেই সংবাদটিই পেলাম।

হা আমার অভিভাবক, আমার শিক্ষক, ছাত্র জীবনে আমার প্রেরণার বাতিঘর, কাজী মতিউর রহমান স্যার। আমার এই আমি হয়ে উঠাতে মা বাবার পর যিনি আমাকে উৎসাহ, প্রেরণা , সহযোগিতা করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন ভালো ছাত্র হিসেবে গড়ে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন- তিনি আর কেউ নন, আমার এই মতিউর রহমান স্যার।

পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি অর্জন করার পর আমার আব্বুর সাথে আলাপ করে পিএইচজি হাই স্কুল থেকে এক রকম জোর করে স্যার আমাকে খলিল চৌধুরী আদর্শ বিদ্যানিকেতনে এনে ভর্তি করিয়েছিলেন। শুধু ভর্তি-ই নয় , একজন অভিভাবকের ন্যায় আমার পড়াশোনার সার্বিক খবরাখবর ও তিনি সর্বদা রাখতেন , যার জন্য এসএসসি পরীক্ষায় খুবই ভালো ফলাফল করতে আমি সক্ষম হয়েছিলাম। আজ স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে ভাবতেই পারছিনা।

শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষকরা হলেন তার সুনিপূন কারিগর। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি কোনভাবেই সম্ভব নয়। অন্ধকারের অতল গহবরে নিমজ্জিত সমাজকে আলোর মুখ দেখাতে পারে একমাত্র সুশিক্ষা। যার কর্ণধার একজন সুশিক্ষক। যাঁরা শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। একজন শিক্ষক হিসেবে (তিন বছর ছয় মাস শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলাম) আমি মনে করি শিক্ষকের কিছু কাজ ও দায়বদ্ধতা আছে। শিক্ষকের এ কাজ ও দায়বদ্ধতা সহকর্মীদের কাছে, সমাজের কাছে, দেশ ও জাতির কাছে, আগামী প্রজম্মের কাছে। তাই শিক্ষা একটি ব্যাপক ও জটিল অর্থবোধক শব্দ। শিক্ষা শব্দের বিশেষ অর্থ হলো বিদ্যাভ্যাস বা অধ্যয়ন করা। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, সুশিক্ষা একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি। সুশিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে এবং বাস্তব ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহায্য করে।

পৃথিবীতে কিছু আলোকিত মানুষের জন্ম হয় যাদের জ্ঞান, মেধা, মনন, আদর্শ সার্বক্ষণিক দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থাকে। এমনই একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন শ্রদ্ধেয় কাজী মতিউর রহমান স্যার। মনে প্রাণে দেশপ্রেমিক এবং সম্পূর্ণ নির্লোভ এক চরিত্রের মানুষ ছিলেন তিনি। মানুষের জন্য একেবারেই নিঃস্বার্থ সেবা ও কল্যাণ ছিল তাঁর শিক্ষকতা পেশার লক্ষ্য। দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা যেন তাঁর প্রাণশক্তি। শিক্ষাবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘শিক্ষার্থীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করবেন শিক্ষক মন মানস দিয়ে। আর এই কাজটি যিনি নিজ দায়িত্বে করবেন তাঁকে আদর্শ শিক্ষক বলা হবে।’ শিক্ষার্থীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করার মাধ্যমে সদ্য প্রয়াত কাজী মতিউর রহমান স্যার পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক।

আমি বিশ্বাস করি, মানবিক উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে মানুষের জন্য কাজ করার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। অর্জিত বিদ্যা বিতরণ ও যৌক্তিক প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের অনালোকিত অধ্যায়কে আলোকিত করার ইচ্ছাই ছিল প্রয়াত কাজী মতিউর রহমান স্যারের লালিত স্বপ্ন। ইতিহাসের পাতায় কাজী মতিউর রহমান স্যার এর নাম লেখা রবে একজন কালজয়ী অনন্য মানুষ হিসেবে। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বরণ্য শিক্ষাবিদ কে হারালো। তাঁর অভাব পূরণ হবার নয়।

সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতীক সৎ মতিউর রহমান স্যারের রেখে যাওয়া কর্মময় জীবন, দর্শন ও দিকনির্দেশনা; শিক্ষকতা পেশা ও দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সকল প্রকার কলুষতা, অন্যায়, অসত্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষক জীবন, ছাত্র জীবন ও সর্বোপরি মানব জীবনে চেতনার নবজাগরণ ঘটাতে সহায়তা করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। মতিউর রহমান স্যারের পরজীবনে আত্মার শান্তি কামনা করি, শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। বিশ্বাস করি স্যার যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন রেখে যাওয়া কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে, জ্বালিয়ে যাওয়া অগণিত বাতির আলোক শিখায়।

লেখক- কানাডা প্রবাসী কবি ও কলামিস্ট।