সিলেট-২ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রথম প্রার্থী হিসেবে দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হন ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে। পরবর্তী চারটি নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীরা ভোটের লড়াইয়ে জয়ের মুখ দেখেননি। দীর্ঘ ২২ বছর পর বিএনপিকে ব্যর্থতার ধারা থেকে ফেরাতে সক্ষম হন এম ইলিয়াস আলী। এর পর আরও দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্য দলের প্রার্থীরা এমপি হয়েছেন। ২০১২ সালে লাপাত্তা হয়ে বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী এখনও ‘নিখোঁজ’। তারপরও আলোচিত এই আসনকে এখনও ‘ইলিয়াসের আসন’ বলেই অভিহিত করা হয়। আগামী নির্বাচনে এ আসন থেকে ইলিয়াসপত্নী তাহসিনা রুশদীর লুনা বিএনপি থেকে প্রার্থী হতে পারেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার তাহসিনা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ এবং সিলেট জেলা কমিটির সদস্য পদও পেয়েছেন। লুনাকে একক প্রার্থী ধরে নিয়ে বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। একাধিক প্রার্থিতার আভাস না থাকায় বিএনপি অনেকটাই স্বস্তিতে আছে। কিন্তু মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতা ও তাদের অনুসারীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে বেকায়দায় আছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।

২০১৪ সালের নির্বাচনে এ আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল জাতীয় পার্টিকে। সেই ভাগ-বাটোয়ারার সুযোগে জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়া বর্তমানে আলোচিত এ আসনের এমপি পদে আছেন। আগামী নির্বাচনেও প্রার্থিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম দুই নির্বাচনে সিলেট-২ আসনের আওতায় ছিল বিশ্বনাথ ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা। তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ আসনে যুক্ত হয় বালাগঞ্জ উপজেলাও। কয়েক বছর আগে বালাগঞ্জের একাংশ নিয়ে গঠিত ওসমানীনগর উপজেলাও বর্তমানে এ আসনের আওতাভুক্ত। তৃতীয় জাতীয় নির্বাচনে সীমানা পুনর্নির্ধারণের পরে অনুষ্ঠিত ছয়টি জাতীয় নির্বাচনের তিনটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিজয়ী হন। দু’বার এমপি হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। ২০০১ সালে সাবেক ছাত্রনেতা ইলিয়াস আলী বিএনপি প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হলেও পরের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। সর্বশেষ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পুনরায় এ আসনের কর্তৃত্ব পায়।

আগামী নির্বাচনে এ আসনে কাউকে ছাড় না দিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থিতা নিশ্চিত করার তৎপরতা শুরু হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি হয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অবস্থান তৈরি করেন শফিকুর রহমান চৌধুরী। এর আগে দীর্ঘ দিন তিনি ছিলেন যুক্তরাজ্যে। কিন্তু গত নির্বাচনে প্রার্থিতার সুযোগ না পেয়ে নিজ দলেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তিনি। কারণ শফিকুরের এক সময়ের সঙ্গী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীও এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থিতা করতে চান। স্থানীয় রাজনীতিতে এ জন্য নিজস্ব বলয়ও গড়ে তুলেছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজমান। শফিকুর রহমানের নিজ উপজেলা বিশ্বনাথে তার দেওয়া আওয়ামী লীগের কমিটি কেন্দ্র থেকে স্থগিত করায় হাইকমান্ডে তার অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে আনোয়ারুজ্জামান মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন বলে মনে করে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একাংশ। এমন পরিস্থিতিতে তিনি নিয়মিত দেশে আসছেন ও ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন। শফিকুর রহমানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের কারণে বিগত উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন বলে মনে করা হয়। সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশ্বনাথের আরেক নেতা মুহিবুর রহমান। সাবেক এই উপজেলা চেয়ারম্যান দীর্ঘ দিন ধরে শফিকুর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। গত নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে তিনি নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। শফিকুর রহমান ও আনোয়ারুজ্জামানের বিভেদের ফলে তৃতীয় পক্ষ লাভবান হতে পারে- এমন ধারণাও করছেন অনেকে। সে ক্ষেত্রে ভাগ্য খুলতে পারে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী জগলুর। জেলা আওয়ামী লীগের এই দপ্তর সম্পাদক বালাগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রার্থিতা করেছেন। তার পরও বিভেদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকায় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সমর্থন তার সঙ্গে আছে বলে দাবি করেন তিনি। বালাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোস্তাকুর রহমান মফুরও মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে দলের সিদ্ধান্তই মুখ্য। দেশের বাইরে অবস্থানরত আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বিভিম্ন সময় প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন এমপি পদে প্রার্থিতার। নির্বাচন প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, বিগত নির্বাচনে দলের বৃহত্তর স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শেষ মুহূর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি। নির্বাচনে অংশ না নিলেও সব সময় এলাকার মানুষের পাশে থেকেছি, দলের জন্য কাজ করেছি। আগামী নির্বাচনে এর মূল্যায়ন আশা করছেন তিনি।

বিএনপি থেকে ইলিয়াসের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর বিএনপির জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। ইলিয়াসের অবর্তমানে বিশ্বনাথের রামধানা গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়ার পাশাপাশি তিনি দলের তৃণমূল পর্যায়ে যোগাযোগও রক্ষা করে চলেছেন। বিএনপি থেকে একক প্রার্থী হিসেবে তিনিই সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। এ নিয়ে লুনা বলেন, ইলিয়াস আলীর অবর্তমানে দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখে খোঁজখবর নিই। তবে নির্বাচনের ব্যাপারে এখনই কিছু বলতে নারাজ তিনি।

এদিকে বিএনপিতে একক প্রার্থী থাকলেও জোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশে সিলেট-২ আসন চাইছে শরিক দল খেলাফত মজলিস। ইতিমধ্যে এ আসনে ইসলামী এই দলের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুনতাসিন আলীকে প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তিনি জানান, জোটের কাছে সিলেট থেকে দুটি আসন চাওয়া হবে। তার মধ্যে এ আসন রয়েছে। একইভাবে আওয়ামী লীগের বিভেদের সুযোগে আগামীতেও এ আসন দখলে রাখার আশায় আছে জাতীয় পার্টি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে না এলেও তারা সুবিধা পাবেন বলে মনে করেন দলের নেতা-কর্মীরা।

বর্তমান এমপি ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়া বলেন, আওয়ামী লীগে অনেক বিভেদ। বিএনপিও ভোটে আসবে কি-না, নিশ্চিত নয়। জাতীয় পার্টির একক প্রার্থীর পাশাপাশি এমপি হিসেবে এলাকার ব্যাপক উম্নয়নের সুবাদে আগামীতেও তিনি বিজয়ী হবেন বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, অতীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সময় এলাকায় সন্ত্রাসের রাজনীতি দেখা গেছে। আমি এমপি হওয়ার পর সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি।

উৎস- দৈনিক সমকাল