বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক শিল্প নগরী প্যারিসে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য জাদুঘর ল্যুভর।
ল্যুভর মিউজিয়াম ছাড়াও আরও বেশ কিছু বিখ্যাত জাদুঘর ফ্রান্সে রয়েছে। তবে পৃথিবীর বিখ্যাত জাদুঘরগুলোর মধ্যে প্রথমে নাম বলতে গেলে বলতেই হয় ল্যুভরের কথা।
এটি এক সময় দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এক সময় ল্যুভর ফ্রান্সের রাজ প্রাসাদ হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এই জাদুঘরটির সামনে কাঁচের তৈরি পিরামিড বসিয়ে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে। তবে এর ইতিহাস কিন্তু এতে একটুও বদলে যায়নি। এই জাদুঘরে প্রাচীন সভ্যতার শুরু থেকে আধুনিক সভ্যতার অনেক কিছুই রাখা আছে। এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটি কিন্তু বেশ দীর্ঘ। বিভিন্ন রাজা-রাজরার শাসন কাল পেরিয়ে ষোড়শ লুই একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুসারে ১৭৯৩ সালে তিনি এই জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন।
প্যারিসের সিন নদীর তীরে অবস্থিত এ বিশাল স্থাপনা আজকের সমকালে এক মহাকালের ধারক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। প্যারিস শহরটা গড়ে উঠেছে সিন নদীর তীর ঘেঁষে। অনেকটা উত্তর-দক্ষিণে আড়াআড়িভাবে অবস্থিত এ নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে ল্যুভর। ১২০০ সালে নির্মিত যে ভবনকে ঘিরে এটি প্রথমে গড়ে ওঠে তা ছিল ফরাসি সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপের রাজকীয় দুর্গ ও প্রাসাদ। শিল্প সংগ্রহশালা হিসেবে ল্যুভরের সার্বিক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হতে সময় লাগে মোট ২০০ বছর। ল্যুভর হচ্ছে নানা ভবনের এক বিশাল সমাহার। ১৫৪৬ সালে এর পশ্চিম দিকের ভবনের কাজ শুরু হয় সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিসের নির্দেশে। শুরুতে এতে কেবল বিভিন্ন রাজকীয় দ্রব্যসামগ্রী প্রদর্শনের জন্য রাখা হতো।
১৯ শতকের পূর্বের ৩৫,০০০ দর্শনীয় বস্তু নিয়ে গঠিত ল্যুভর মিউজিয়াম ৬,৫২,৩০০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে অবস্থিত। ১২ শতকে জাদুঘর স্থানে ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ একটি দূর্গ নির্মাণ করেন। যা পরবর্তীতে ল্যুভর প্রাসাদ হিসেবে রুপান্তরিত করে জাদুঘর তৈরী করা হয়। তবে পূর্বের দূর্গটির কিছু অংশ এখনও দৃশ্যমান। ল্যুভর প্রাসাদটি বিভিন্ন সময়ে বর্ধিত করা হয়েছে। ১৬৮২ সালে ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইস তাঁর বাসস্থান ল্যুভর হতে ভার্সাইলস প্রাসাদে স্থানান্তর করেন। এরপর হতে ল্যুভর প্রাসাদকে প্রাথমিকভাবে রাজকীয় সংগ্রহশালা দর্শনালয় হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৬৯২ সালে এখানে একটি প্রাচীন ভাস্কর্য সংগ্রহ করে আনা হয়। ঐ বছর দালানটি সংরক্ষণের দায়িত্ব কাব্যশাস্ত্র ও লিপি শিক্ষালয় এবং রাজকীয় অঙ্কন ও ভাস্কর্য শিক্ষালয়ের যৌথ পরিষদের উপর ন্যস্ত হয়। ১৬৯৯ সালে জাদুঘরটিতে যৌথ পরিষদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যৌথ পরিষদটি ১০০ বছর বিদ্যমান ছিল।
ফরাসি বিপ্লবের সময় ফরাসি জাতীয় পরিষদ, জাতীয় সেরা শিল্প কর্মগুলো প্রদর্শনের জন্য লুভর প্রাসাদকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহারের জন্য ফরমান জারি করে। ১০ আগষ্ট ১৭৯৩ সালে ৫৩৭ টি শিল্পকর্ম প্রদর্শনের মাধ্যমে ল্যুভর জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন শিল্পকর্মগুলোর অধিকাংশ ছিল রাজকীয় এবং চার্চের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি। গঠনপ্রণালীতে সমস্যা থাকায় ১৭৯৬ হতে ১৮০১ সাল পর্যন্ত জাদুঘরটি বন্ধ থাকে। ফ্রান্সের সম্রাট প্রথম নেপোলিয়ন জাদুঘরটির পরিবর্তিন নাম দেন “নোপোলিয়ন জাদুঘর“। সেইসাথে জাদুঘরটির সংগ্রহশালা বৃদ্ধি করেন। ওয়াটারলু যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হতে তাঁর সৈন্যগণ জাদুঘরটির অনেক শিল্পকর্ম দখল করে সেগুলো মূল মালিকের কাছে ফেরত প্রদান করে। রাজা অষ্টাদশ লুইস ও রাজা দশম চার্লদসের শাসনকালে জাদুঘরটির সংগ্রহ আবার বৃদ্ধি করা হয়। পরবর্তীকালে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যতিত বিভিন্ন সময়ে দান অথবা উপহারের মাধ্যমে সংগ্রহ আস্তে আস্তে বৃদ্ধি করা হয়। জাদুঘরটির সংগ্রহশালা আটটি ভাগে বিভক্ত – মিশরীয় পুরাতত্ত্ব; নিকট প্রাচ্য পুরাতত্ত্ব; গ্রিক, এট্রাস্কান ও রোমান পুরাতত্ত্ব; ইসলামিক শিল্পকলা; ভাস্কর্য; সজ্জা সংক্রান্ত শিল্প; অঙ্কনশিল্প এবং ছাপা শিল্প। এখানেই রয়েছে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি‘র অংকিত সেই পৃথিবীখ্যাত ঐতিহাসিক ছবি “মোনালিসা“। ল্যুভর এর পুরো বিল্ডিংটাকে মিউজিয়াম বানাতে প্রায় ২০০ বছর লেগেছিল।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া ও প্যারিস দর্পন