আহমেদাবাদে আজ ত্রয়োদশ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি ইতিহাসের সেরা দল ও চলতি বিশ্বকাপের সেরা দল। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া ও দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের মহারণ। নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে আজ রাতে বিজয়ীর মঞ্চে থাকবে ভারত, না অস্ট্রেলিয়া? ষষ্ঠ মুকুট উঠবে কি অজিদের মাথায়, নাকি রোহিত-কোহলিরা পাবেন তৃতীয়বারের মতো শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট?
টানা ১০ জয়ে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা জোরালো করেছে ভারত। ১৯৮৩ সালে কপিল দেবের নেতৃত্বে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয় করে দেশটি। ২৮ বছরের অপেক্ষা শেষে ২০১১ সালে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে শ্রীলংকাকে হারিয়ে ‘মেন ইন ব্লু’রা পায় দ্বিতীয় বিশ্ব শিরোপার স্বাদ। আজ তাদের সামনে তৃতীয় শিরোপার হাতছানি। এ পথে বাধা বিশ্বকাপের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া।

২০০৩ সালে জোহানেসবার্গ ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া সেবার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবার ভারতের সামনে সেই হাতছানি। সেবার ভারত মাত্র দুটি ম্যাচ হেরেছিল, দুটিই অস্ট্রেলিয়ার কাছে। গ্রুপ পর্বে হারের পর ফাইনালেও অজিদের কাছে পরাজিত হন সৌরভরা। এবার গ্রুপ পর্বে ভারতের কাছে হেরেছে প্যাট কামিন্সের দল। আজ ফাইনালেও ফেভারিট হিসেবে নামছে স্বাগতিকরা। এমন মিল দেখার পরই প্রতিশোধের হিসাব-নিকাশটা বাড়তে শুরু করেছে।
সেবার দুই দল খেলেছিল নিরপেক্ষ ভেন্যুতে। এবার লড়াইয়ের ময়দানটা ভারতের। নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে সোয়া লাখেরও বেশি দর্শক আজ বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখবেন, যার বেশির ভাগই কিন্তু গলা ফাটাবেন ভারতের হয়ে। সেই তুলনায় অজি সমর্থক থাকবেন মুষ্টিমেয়। গ্যালারির লড়াইয়ে ভারতের জয় নিশ্চিতই।
যদিও ভারতের এ বিপুল দর্শককে চুপ করিয়ে দিতে চান অজি দলনায়ক প্যাট কামিন্স। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘এটা পরিষ্কার যে দর্শক সমর্থন একপেশেই হবে। জানি, স্টেডিয়াম ফুলহাউজ হবে। প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শক ভারতকে সমর্থন করবে। কিন্তু বিশাল দর্শককে চুপ করিয়ে দেয়ার মতো সন্তোষজনক আর কিছু খেলায় নেই। আগামীকাল (আজ) সেটাই আমাদের লক্ষ্য। ফাইনালের প্রতিটি অংশকেই আপনার মেনে নিতে হবে। এটা তো আগে থেকেই সবার জানা ছিল যে ফাইনালের দিন অনেক মানুষের শোরগোল হবে, যা আপনাকে অভিভূতই করে দেবে।’
এরপর মাঠের লড়াই, বাইশ গজের লড়াইয়ে একে অন্যকে হারানোর চ্যালেঞ্জ। এ লড়াই হবে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। বর্তমান ফর্মের বিচারে সেটাই হওয়ার কথা।
ভারতের সাবেক অধিনায়ক সুনীল গাভাস্কারও মনে করেন, অবিশ্বাস্য এক ফাইনাল হতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আপনি পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে খেলতে যাচ্ছেন। তারা এমনই এক দল যারা এমন জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, যা কিনা অনেকের জন্য প্রায় অসম্ভব। ফাইনাল কীভাবে খেলতে হয়, কীভাবে জিততে হয়, তারা জানে। কাজেই আমি বিশ্বাস করি, এটা ভারতের জন্য সত্যিকার, সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জিং হতে চলেছে। পাশাপাশি এটাও বিশ্বাস করি, এ লড়াইয়ে রোহিত শর্মার দলই এগিয়ে থাকবে।’
তবে ফাইনালে খুব বেশি চাপ নিতে চান না রোহিত। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘জিতলে খুব ভালো লাগবে, কারণ আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছি। ড্রেসিংরুমে অনেকের মধ্যে উদ্বেগ আছে, আমি এটা লুকাব না। এটাই খেলার সৌন্দর্য। আমি আগেও বলেছি, ভারত প্রতিটি ম্যাচেই যেন ফাইনাল খেলে। আমরা যাত্রাটা উপভোগ করছি। এখন শেষটা ভালো করতে হবে।’
ভারত চলতি আসরের সেরা দল। রাউন্ড রবিন লিগে টানা ৯টি জয় তুলে নেয়ার পর সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৯৭ রানের সৌধ গড়ে জিতেছে তারা ৭০ রানে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটছে ভারত। ফাইনালের পথে একের পর এক দলকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছে তারা। প্রথম পাঁচ ম্যাচে রান তাড়া করে দাপটে জিতেছে রোহিত শর্মার দল। পরের পাঁচ ম্যাচে তারা জিতেছে যথাক্রমে ১০০, ৩০২, ২৪৩, ১৬০ ও ৭০ রানে! এ জয়গুলোই বলছে, ব্যাট-বলে কতটা প্রতাপ দেখিয়ে ফাইনালে উঠেছে ভারত।
ভারত জিতেছে টানা ১০ ম্যাচ। আর অজিরা দুটিতে হেরে যাওয়ার পর টানা আট ম্যাচ জিতে ফাইনালে উঠেছে। দুই দলের ফর্ম নিয়ে কামিন্স বলেন, ‘তারা খুবই ভালো ক্রিকেট খেলে চলেছে। টুর্নামেন্টের অপরাজিত দল। কিন্তু বিশ্বাস আছে, নিজেদের সেরাটা দিয়ে তাদের কাঁপিয়ে দিতে পারি আমরা।’
ভারতকে তৃতীয় শিরোপার স্বপ্ন দেখাচ্ছে রোহিতের দল। গোটা দলই যেন জীবনের সেরা ফর্মে রয়েছে। ব্যাটিং সুপারস্টার বিরাট কোহলি যেন ভিনগ্রহের কোনো ব্যাটার। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক বিশ্বকাপ আসরে ৭০০ রান করেছেন তিনি এবার। ১০ ম্যাচে কোহলির ব্যাট থেকে এসেছে ৭১১ রান! এছাড়া ‘হিটম্যান’ খ্যাত রোহিত শর্মা ৫৫০ রান ও মিডল অর্ডারের ভরসার নাম শ্রেয়াস আইয়ার ৫২৮ রান করেছেন। সঙ্গে শুভমান গিল ও লোকেশ রাহুলও সুযোগ পেলেই তিন অংক ছুঁয়ে ফেলার সামর্থ্য রাখেন। নিচের দিকে সূর্যকুমার যাদব কিংবা রবীন্দ্র জাদেজার ব্যাটেও অনেক ভরসা ভারতীয় দলের।
এ বিশ্বকাপে কাদের বোলিং সেরা, সেটি নিয়ে তর্ক হতেই পারে। তবে এককভাবে মোহাম্মদ শামিই যে সেরা, সেটি নিয়ে কারো বোধকরি আপত্তি থাকার কথা নয়। ৬ ম্যাচে ২৩ উইকেট নিয়ে চার্টের শীর্ষে তিনি! বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার তিনি। ৫৪ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসে উঠে গেছেন ছয় নম্বরে।
শুধু শামিই নন। ধূমকেতুর মতো শামির আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত এ বিশ্বকাপে ভারতের পেস বোলিংয়ে সবচেয়ে বড় ভরসা হয়ে জ্বলছিলেন জসপ্রীত বুমরাহ। ১০ ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়ে তিনি আছেন তালিকার পাঁচে। বৈচিত্র্যময় বোলিং অ্যাকশনের অধিকারী এ ডানহাতি পেসার আজ নতুন বলে কঠিন চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দেবেন ডেভিড ওয়ার্নার ও ট্রাভিস হেডকে। বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ২০২৩ সালে ভারতের সেরা বোলার মোহাম্মদ সিরাজ খানিকটা নিষ্প্রভ। ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ১৩ উইকেট।
আজ অজিদের ভোগাতে পারেন ৩৪ বছর বয়সী বামহাতি অর্থোডক্স স্পিনার রবীন্দ্র জাদেজা। ২২.১৮ গড়ে নিয়েছেন ১৬ উইকেট, ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন মোটে ৪.২৫! অবিশ্বাস্য। ভুলে যাবেন না আরেক বামহাতি স্পিনার কুলদীপ যাদবকে। তিনি নিয়েছেন ১৫ উইকেট। তিনি ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ৪.৩২ করে। এ যেন জাদেজার সঙ্গেই একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াই।
ক্রমে ভয়ংকর হয়ে উঠছে অজি পেস আক্রমণও। সেমিফাইনালে প্রোটিয়াদের ২৪ রানের মধ্যে ৪ উইকেটের পতন ঘটান মিচেল স্টার্ক, জস হ্যাজেলউড। অধিনায়ক প্যাট কামিন্সও মাঝেমধ্যে ব্রেক থ্রু এনে দিচ্ছেন। বিশ্বকাপে হ্যাজেলউড ১৪টি, স্টার্ক ও কামিন্স ১৩টি করে উইকেট নিয়েছেন। ২২ উইকেট নিয়ে চার্টের দুইয়ে লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা। যদিও আগের ম্যাচে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে তিনি ছিলেন নির্বিষ। ৫৫ রান খরচায় কোনো উইকেট পাননি। আজ ফাইনালে তার ব্যক্তিগত মিশনও রয়েছে। উইকেট চার্টের শীর্ষস্থান দখলের লড়াই হবে তার শামির সঙ্গে।
আজ ফাইনালের মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত ডুয়াল থাকবে জিভে জল আনার মতোই। রোহিত বনাম স্টার্ক, কোহলি বনাম জাম্পা কিংবা বুমরাহ বনাম ওয়ার্নার, হেড বনাম শামি, স্মিথ বনাম জাদেজা—এ ডুয়ালগুলো রোমাঞ্চ ছড়াবে নিশ্চয়ই।