একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলা নিয়ে সিলেট-৫ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মহাজোট ও জোট আতঙ্কে ভুগছেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ দলীয় মনোনয়ন পেলেও পরে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে বলি হন। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে এমপি হন বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা কেন্দ্রীয় জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব সেলিম উদ্দিন।

২০০৮ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসন থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় চারদলীয় জোটের জাতায়াত নেতা মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীকে। এর মধ্যে ২০০১ সালে ফরিদ উদ্দিন বিজয়ী হলেও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের হাফিজ আহমদ মজুমদারের কাছে তিনি হেরে যান। ২০০৮ সালে হাফিজ মজুমদার পান ১ লাখ ৯ হাজার ৬৯০ ভোট। ফরিদ উদ্দিন পান ৭৮ হাজার ৬১ ভোট। গত নির্বাচনে বিএনপি ও চারদলীয় জোট অংশগ্রহণ করেনি। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত উভয়েই এ আসনে নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে।

সিলেট জেলা জামায়াতের দক্ষিণের আমীর মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেছেন, এখনও জোট বহাল রয়েছে, আমাদের দল এ আসনের দাবিদার।

নব্বইয়ের পটপরিবর্তনের পর ১৯৯১ সালের ভোটে বিজয়ী হন ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা উবায়দুল হক উজিরপুরী, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির ভোটে এমপি হন বিএনপির আবুল কাহির চৌধুরী, ’৯৬-এর ১২ জুনের ভোটে এমপি হন আওয়ামী লীগের হাফিজ আহমদ মজুমদার। আগামী নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শরিকদের ছাড় দিতে নারাজ। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ সেলিম উদ্দিন এমপি হওয়ার পর স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ত করেননি। আওয়ামী লীগ এলাকায় পিছিয়ে পড়ছে। একই অভিযোগ স্থানীয় বিএনপিরও।

নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন পেতে দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি তৃণমূলকেও রাজি-খুশি করার চেষ্টা করছেন। তারা নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। অংশ নিচ্ছেন দলীয় ও ধর্মীয় সব কর্মসূচিতে।

তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিভক্তি রয়েছে। প্রার্থী পছন্দ না হলে অন্যের সঙ্গে আঁতাত করে দলের প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়ার রেওয়াজ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে এলাকায়। ভোটের দিন পর্যন্ত কোন্দল অব্যাহত থাকলে ভোটের মাঠে তার প্রভাব পড়তে পারে।

আগামী নির্বাচনের জন্য হাল ছাড়েননি মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাসুক উদ্দিন বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর আমার আস্থা আছে। গত নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দেয়া হলেও পরে দলের স্বার্থে প্রত্যাহার করে নিই। বেইমানি করি নাই। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। নেত্রী আমার কর্মের মূল্যায়ন করবেন।

মাসুক উদ্দিন ছাড়াও আওয়ামী লীগের অপর মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন- সিলেট বিভাগীয় আইনজীবী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোস্তাক আহমদ, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আহমদ আল কবির, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ও রমনা-শাহবাগ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল মুনির চৌধুরী এবং সিলেট মহানগর কৃষক লীগের সভাপতি আবদুল মোমিন চৌধুরী।

১৯৭৮ সালে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমদ পরে সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। সুপ্রিমকোর্টে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সাবেক সহসভাপতি মোস্তাক আহমদ বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে এলাকাবাসী আমাকে প্রার্থী হিসেবে চাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী আহমদ আল কবির যুগান্তরকে বলেন, মনোনয়ন পেলে নির্বাচন করব। সে লক্ষ্যে এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি। এলাকার উন্নয়ন করতে সংসদে যেতে চাই।

সংসদের বিরোধীদলীয় হুইপ বিয়ানীবাজার উপজেলার বাসিন্দা সেলিম উদ্দিন এমপি ছাড়াও এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা হলেন- দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জকিগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান শাব্বির আহমদ ও কেন্দ্রীয় সদস্য শিল্পপতি এম জাকির হোসেইন। ইতিমধ্যে সেলিম উদ্দিন এ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছেন। জানতে চাইলে সেলিম উদ্দিন বলেন, অবহেলিত এ আসনের এমপি হয়ে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। অনেক নির্যাতনের শিকারও হয়েছি। এখানকার মাটি ও মানুষের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। অনেক প্রকল্প এখনও প্রক্রিয়াধীন। অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে এ আসন থেকে নির্বাচন করতে চাই। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।

শাব্বির আহমদ বলেন, গত নির্বাচনে দলের টিকিট পেয়েছিলাম। বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা আমার ওপর হামলা চালিয়ে গাড়ি পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে। বোমা হামলা করেছে। শেষ পর্যন্ত পার্টির চেয়ারম্যানের নির্দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহার করি। আগামী নির্বাচনে পার্টি আমাকেই মনোনয়ন দেবে।

জাতীয় পার্টির আরেক প্রার্থী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা ছাত্রসমাজের সাবেক সভাপতি এম জাকির হোসেইন বলেছেন, পার্টির চেয়ারম্যানের জন্য অনেক ত্যাগস্বীকার করেছি। এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে থাকার চেষ্টা করেছি। নেতাকর্মীদের চাপে মনোনয়ন চাচ্ছি। পার্টির মনোনয়ন পেলে নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। এ ছাড়াও পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য সাইফুদ্দিন খালেদও রয়েছেন পার্টির মনোনয়ন দৌড়ে।

আগের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি আসনটি জামায়াতকে ছাড় দিলেও আগামী নির্বাচনে ছাড় দিতে চাইছে না জামায়াতকে। নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় আশাবাদী হয়ে উঠেছেন বিএনপির নেতারা। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে আছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির সভাপতি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন জাকির হোসেন, সাবেক এমপি আবুল কাহির চৌধুরী, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর ভাই কানাইঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ও কানাইঘাট উপজেলা বিএনপির সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সাবেক আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক মামুনুর রশিদ মামুন।

জানতে চাইলে জাকির হোসেন বলেন, এ আগে আসনটি জামায়াতকে ছেড়ে দেয়ায় ভোটাররা ধানের শীষে ভোট দিতে পারেননি। দলীয় নেতাকর্মীরা এ অবস্থার পরিবর্তন চায়। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ থাকলে বিএনপি নির্বাচনে গেলে আমি ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করার ব্যাপারে আশাবাদী। আবুল কাহির চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জামায়াতের কোনো প্রার্থী চাই না। দলের নেতাকর্মীরা ধানের শীষ প্রতীক চায়।’ দল থেকে মনোনয়ন পেলে অবশ্যই নির্বাচন করব।

কানাইঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘দল যাকে মনোনয়ন দেবে আমরা তাকে বিজয়ী করতে কাজ করব। তবে দলের নেতাকর্মীরা আগামী নির্বাচনে এ আসনে ধানের শীষ প্রতীকেই ভোট দিতে চায়।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সাবেক আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, ‘অনেক দিন ধরে এ আসনে দলের প্রার্থী না থাকায় জকিগঞ্জ-কানাইঘাটে দল অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় কাজ করছি। আগামী নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করতে চাই। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।

১৯৯১ সালে খেলাফত মজলিসের উবায়দুল হক উজিরপুরী এ আসন থেকে এমপি হন। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য খেলাফত মজলিসের যুগ্ম সম্পাদক এনামুল হাসানের দলীয় প্রার্থিতা চূড়ান্ত বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাহর সভাপতি মাওলানা হুসামুদ্দিন চৌধুরী ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক এ আসনে প্রার্থী হতে পারেন।

সূত্র- দৈনিক যুগান্তর।