গ্রামের নাম লালবাগ। গ্রামটির গল্প অনেকটা সিনেমার মতো। প্রতিদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আকাশপথে মানুষের অবিরাম আসা যাওয়া এই গ্রামের উপর দিয়ে। এই দৃশ্য দেখে দেখে গ্রামের মানুষগুলো বড় হলেও ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রানওয়ের দেয়াল ঘেঁষে থাকা লালবাগ গ্রামটি।

উড়োজাহাজের আসা-যাওয়া অনেকের কাছে রোমাঞ্চকর হলেও লালবাগ গ্রামের মানুষের অনেকটা বিড়ম্বনার। তবে এই গ্রামেই অনেক মানুষ উড়োজাহাজের উড্ডয়ন দৃশ্য এক পলক দেখতে আসনে গ্রামটিতে। সুনীল আকাশে বিমানের উড্ডয়ন আর অবতরণ দেখে দেখে পার করেন বেলা।

সিলেট নগরী থেকে লালবাগ গ্রামের দূরত্ব প্রায় এগারো কিলোমিটার। গ্রামটির অবস্থান সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর ইউনিয়নে। রানওয়ের পাশে থাকায় দূর থেকে গ্রামকে সাজানো মনে হয়। বাস্তবে বোঝার উপায় নেই তার ভেতরের শূন্যতা। একপাশে বিমানবন্দরের রানওয়ে অন্যদিকে সারি সারি পাথর ভাঙার মেশিনের শব্দ। তার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু একটি কাচা পথ মাড়ালেই চোখে পড়ে গ্রামটি।

এক সময় ৩৬৫টি পরিবার ছিলো পুরো লালবাগ গ্রামে। বর্তমানে রয়েছে ৭৬টি । ১৯৯৮ সালে যখন বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়। লালবাগ গ্রামের দুই তৃতীয়াংশ জায়গা তখন রানওয়ের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। গ্রামটির মানচিত্র ছোট হওয়ার গল্পের শুরু এখানে। কেউ রানওয়ের পাশে, কেউবা চলে যান বাসাবাড়ি বানিয়ে অন্য কোথাও।

উচু উচু দালানকোঠা খুব একটা চোখে পড়ে না লালবাগ গ্রামে। নেই কোনো স্কুল। অনেক দূর পাঁয়ে হেঁটে অন্যগ্রামের স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে হয় শিশুদের। আছে শুধু জামেয়া ইসলামিয়া লালবাগ নামের একটি কওমি মাদরাসা। গ্রামে পরিবারগুলোর অধিকাংশই অসচ্ছ্বল।

লালবাগ গ্রামের বাসিন্দা শিপন আহমদ জানান, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের ‘অনেক কাছের মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আবার কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছে কিছু উৎসুক মানুষকে। যারা উড়োজাহাজের উড্ডয়ন-অবতরণের দৃশ্য দেখে আনন্দ পান। এতেই আমরা আনন্দ পাই।

প্রবীণ মুরব্বী নূর মিয়া জানান, পুরনো সেই মসজিদটি এখনো রয়ে গেছে রানওয়ের সীমানার ভেতর। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ গ্রামের মানুষের সুবিধার্থে রানওয়ের বাইরে নতুন একটি মসজিদ নির্মাণ করে দিয়েছেন। তবুও আমাদের অন্তর পড়ে আছে অতীতের সোনালী স্মৃতি জড়ানো সেই মসজিদে। সীমানার গেইট খুলে দিলে সেই মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করলে শান্তি মিলে।

মায়েরা উড়োজাহাজের শব্দের ভেতর ঘুম পাড়ান সন্তানদের, সেই শব্দ নিয়ে আবার ভোর আসে। এভাবেই রাত আসে, দিন যায়। শিশুরা বড় হয়। কেবলই বড় হয়না লালবাগ গ্রামটি। উল্টো ধীরে ধীরে বাপ-দাদার সেই ভিটা ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকেই। বিমানবন্দরের রানওয়ে আরো সম্প্রসারিত হবে একদিন। তখন হয়তো বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে লালবাগ নামের গ্রামটি।